স্টাফ রিপোর্টার : মানিকগঞ্জে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পাঁচ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। তারা হলেন সফল জননী নারী ছায়া রানী সাহা, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী রফিজা বেগম, সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখা নারী রাবেয়া আক্তার, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী ইভা দাস ও শিক্ষা-চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী সোনিয়া আক্তার। তাদের সাফল্যের গল্প তুলে ধরেছেন।
ছায়া রানী সাহা, স্বামী কার্তিক লাল সাহা, ঘিওর, মানিকগঞ্জ। সচেতনার অভাবে মাত্র ১৫ বছর বয়সে আমার বাল্য বিয়ে হয়। বিয়ের ৮ বছরের মাথায় আমার ৪টি সন্তান জন্ম নেয়। যৌথ পরিবারের সাংসারিক ঝামেলায় আমি স্বামী ও আমার সন্তানদের দেখাশুনা করতে পারতাম না। ঠিকমত পরিবারের খাবারও জোগাড় করা কষ্ট হয়ে পড়েছিল। পুষ্টিহীনতায় আমার স্বামী হঠাৎ অন্ধ হয়ে যায়। এতে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। তারপর নিজের গহনাপত্র বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসা করে সুস্থ্য করি। নানান প্রতিকুলতায় জীবনযুদ্ধে হার মানিনি। স্বামী ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বিভিন্ন স্থানে মালপত্র নিয়ে বিক্রি করতো। সাত থেকে ১৫দিন পর পর বাড়ি আসতো। আমি স্বামীকে আর্থিক সচ্চল করতে হাঁস-মুরগী পালন ও ডিম বিক্রি করে আমি স্বামীকে আর্থিকভাবে সহযোগীতা করি। চার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করি। তাদের লেখাপড়ার খরচ নিজেই বহন করি। এতে নানা ঘাত পতিঘাতের মধ্য দিয়ে সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছি। আমাকে দেখে সমাজের অন্যান্য নারীরা জীবনমান পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। সমাজের নানান সমস্যায় আমি পরামর্শ দিয়ে থাকি। আমার সন্তানদের মধ্যে এক মেয়ে ডাক্তার ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, এক ছেলে ব্যাংকার ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, এক ছেলে সরকারি কলেজের শিক্ষক ও এক ছেলে সংবাদপত্রের অফিসে চাকুরী করে। আমার স্বপ্ন পূরন হয়েছে। আমি আজ সফল মা হিসেবে দাবী করি। তাই আমি সফল জননী। আমার ভবিষ্যত ইচ্ছা সন্তানরা দেশের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করবে।
মোসাম্মৎ রফিজা বেগম, পিতা- মোঃ রফিক দেওয়ান, গ্রাম-নারিকুলী, ডাকঘর-আটিগ্রাম, উপজেলা ও জেলা মানিকগঞ্জ। ১৬ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে স্বামীর সংসারে শশুরবাড়ির লোকজন স্বামীসহ আমাকে নানানভাবে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করতো। আমার স্বামী ৮মাস বয়সী আমার পুত্র সন্তানসহ আমাকে তালাক দেয়। শিশু সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসি। দারিদ্রতায় জর্জরিত বাবার সংসারে আমার জীবনে নেমে আসে অনেক দুঃখ-কষ্ট। আমি ভেঙ্গে না পড়ে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সংগ্রাম শুরু করি। তৎকালীন বেসরকারি এনজিও প্রতিষ্ঠান প্রশিকা কর্তৃক প্রচারিত নাট্য শিল্প অনুষ্ঠানে নাটকে অভিনয় শুরু করি। আমি মুসলিম নারী হয়েও নাটকে অভিনয় করাকে ভালভাবে দেখেনি সমাজের মানুষ। সমাজে আমাকে এক ঘরে করে রাখে। উপায়ন্ত না দেখে আমি গরু-ছাগলের টিকা/ভ্যাকসিন বিক্রি করে সন্তানের পড়ার খরচ ও সংসার চালাতে থাকি। অনেক দুঃখ, কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে সন্তানকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করিয়ে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাস্টার্স লেবেল পর্যন্ত পড়াশুনা করাই। বর্তমানে আমার ছেলে বাংলাদেশ সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রনালয়ের অফিস সহকারি হিসেবে চাকুরী করছে। ১৯৯৮ সাল থেকে আটিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ৩নম্বর ওয়ার্ডে মহিলা সদস্য হিসেবে পর পর ৪বার নির্বাচিত হয়ে ২৪ বছর ধরে জনগনের সেবা করি। বাল্য বিবাহ, যৌতুক, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধমুলক কাজ করে আসছি। ১০শতাংশ জমি কিনে ঘর করেছি। আমি এখন স্বচ্ছল জীবনযাপন করছি। অনেক জীবন সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সমাজের অনেকেই আমার ব্যক্তিগত, পারিবারিক সমস্যার পরামর্শ নিতে আমার কাছে আসে।
আমি রাবেয়া আক্তার পিতা মোঃ জেহের আলী, মাতা জহুরা বেগম। আমি সদর উপজেলার গড়পাড়ার বাজেয়াপ্ত ভাটারা গ্রামে ১৯৭১সালে জন্মগ্রহন করি। গড়পাড়া আলীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেনী, গড়পড়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও দেবেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করি। সমাজের অবহেলিত নারীদের কল্যানে ১৯৯৮ সালে সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচীর পল্লী সমাজ সংগঠনে যোগ দিয়ে পল্লী সমাজের সভাপ্রধান নির্বাচিত হই। নারীদের নিয়ে সচেতনতামূলক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন উঠোন বৈঠক করি। ২৮টি বাল্য বিয়ে বন্ধ করি। ৩৫টি যৌতুক বিহীন বিয়ের ব্যবস্থা করি এবং প্রায় ১৫০টি পরিবারে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলি এবং বিভিন্ন ধরনের র্যালী, মানববন্ধন ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি। ১৯৮৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনে ও ১৯৯৭ সালে সরাসরি জনগনের ভোটে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হই্। টানা ১৫ বছর ইউপি সদস্য হিসেবে গরীব মানুষের কল্যানে নিজেকে নিবেদিত করি। বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ, কৃষি উপকরণ বিভিন্ন দুঃস্থ মানুষেল মাঝে বন্টন করি। ১৯৯৮ সালে ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচী পল্লী সমাজের প্রধান হয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও কল্যানমুলক গরীব মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করি। এলাকার গরীব ও দুস্থ শিশুদের বিনা বেতনে স্কুলে পড়ার সুযোগ, ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলগামী করাসহ এলাকার রাস্তাঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট উন্নয়নে কাজ করি। আমার ইচ্ছা ভবিষ্যতে মহিলাদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষন কেন্দ্র স্থাপন করে আত্মনির্ভরশীল করতে সহযোগীতা করবো।
ইভা দাস, পিতা কার্তিক রবি দাস, মাতা গীতা দাস, গ্রাম পশ্চিম দাশড়া, লঞ্চঘাট, মানিকগঞ্জ সদর । আমি অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে ও সমাজের চোখে নিচু শ্রেনীর মানুষ হিসেবে ৮ম শ্রেনী পর আর পড়াশুনা করতে পারিনি। প্রতিভা বিকাশের সুযোগও পায়নি। তবে আমি থেমে না থেকে যুব উন্নয়ন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে বিউটি পার্লারে প্রশিক্ষন নিই। বাবা জুতোর কাজ করতো বলে অনেকেই আমাদের নিচু জাত বলে অবজ্ঞা করতো। আমি প্রশিক্ষিত হয়ে একটি বিউটি পার্লার দিই। আমি নিজে লেখাপড়া করতে পারিনি। কিন্তু আমার ছোট বোন ইতির লেখাপড়ার খরচ বহন করি। আমি বিশ্বাস করি পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। আমি দরিদ্র অবস্থার পরির্তন করেছি। নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে সংসারের অর্থনৈতিক উন্নতি ও বোনদের পড়ালেখা শিখিয়েছি। বর্তমানে বিউটি পার্লারের পাশাপাশি একটি জামাকাপড় ও কসমেটিকসের দোকান দিয়েছি। আমি আজ নিজের পরিবার ও সমাজে আলাদাভাবে সম্মান পাই। আমি চাই গ্রাম-গঞ্জে, শহরে অস্বচ্ছল পরিবারের মেয়েরা বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে নিজে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক। আমি সংগ্রাম করে অর্থনৈতিকভাবে সফল হয়েছি।
আমি সোনিয়া আক্তার, পিতা সোহরাব হোসেন, মাতা শেফালী বেগম, গ্রাম চকমিরপুর, উপজেলা দৌলতপুর, জেলা মানিকগঞ্জ। আমার জন্ম অতি দরিদ্র ও অশিক্ষিত পরিবারে। দরিদ্রতার কারণে ছোট বেলায় স্কুল যেতে দিতো না । এক ব্র্যাক কর্মীর সহযোগীতায় ব্র্যাক স্কুলে ভর্তি হই। পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত প্রতি শ্রেনীতে প্রথম হওয়ায় স্কুলের শিক্ষক ও এনজিও ব্র্যাক কর্মচারীদের নিকট প্রশংসা পাই। পাশাপাশি বাড়িতে শুরু করি হাঁস-মুরগী পালন। অষ্টম শ্রেনী পাস করার পর প্রাইমারী স্কুলের ছেলে মেয়েদের টিউশনী করাই। এভাবে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করি। বর্তমানে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। পাশাপাশি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে সেলাই, কম্পিউটার ও গবাদিপশু পালনের প্রশিক্ষন গ্রহন করি। নিজের চেষ্টায় পড়ালেখার পাশাপাশি পরিবারের কিছু আর্থিক সহযোগীতা করতে পারছি। আমার চেষ্টার সাফল্য দেখে এলাকার অনেক মেয়েরা এগিয়ে আসছে। বলতে চাই দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও নিজের অবস্থার পরিবর্তন করেছি। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সফল নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি।##