সম্প্রতি দেশব্যাপী পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের সময় শিক্ষার্থী, ব্যক্তিগত গাড়ির চালক ও যাত্রীদের মুখে পোড়া মোবিল মাখানোসহ কান ধরে ওঠবোসের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘ঢাকা জেলা ট্রাক, ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন’-এরসহ-সেক্রেটারি আমির হোসেন ও ক্যাশিয়ার আব্দুল জব্বারকে বহিষ্কার করে ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেড়ারেশন’। তবে, এই সিদ্ধান্তকে সাংগঠনিক দ্বন্দ্বের জের হিসেবে দেখছেন বহিষ্কৃত দুই নেতা। তাদের দাবি, এর মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেড়ারেশনের নেতারা বলছে—ধর্মঘটে পোড়া মোবিল হামলাকারী দুই শ্রমিককে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা হলেন—বরিশালের মৃত মহব্বত আলী সরদারের ছেলে যাত্রাবাড়ী এলাকার শ্রমিক আবুল কাশেম অলী ও একই এলাকার বিল্লাল হোসেন। তারা ধর্মঘট আহ্বানকারী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেড়ারেশনের অন্তর্ভুক্ত ঢাকা জেলা ট্রাক, ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সদস্য। আর এই দুই শ্রমিককে সহযোগিতা করেছেন একই ইউনিয়নের বর্তমান সহ-সেক্রেটারি আমির হোসেন ও ক্যাশিয়ার আব্দুল জব্বার। প্রমাণ পাওয়ার পর এই দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান শ্রমিক নেতা রয়েছেন।ফেড়ারেশনের অভিযোগ, সাবেক এই দুই শ্রমিকনেতা ঘর্মঘটে নানা অপ্রীতিকর কাণ্ড ঘটিয়ে দেশজুড়ে সাধারণ নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের ক্ষেপিয়ে তুলে ফায়দা লুটতে চেয়েছেন। তারা যাত্রাবাড়ী এলাকার শ্রমিক ও ঢাকা জেলা ট্রাক, ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সদস্য আবুল কাশেম অলী ও বিল্লাল হোসেনসহ আরও বেশ কিছু শ্রমিককে দিয়ে চালক, যাত্রী ও শিক্ষার্থীদের গায়ে ও মুখে পোড়া মোবিল মাখানোসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছেন। এরআগেও পণ্যপরিবহন ধর্মঘটের সময় এই দুই নেতা এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন। এমন অভিযোগে ঢাকা জেলা ট্রাক, ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাতি ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে গত ৯ অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারী থানায় একটি মামলা করলে মামলাটি সাধারণ ডায়েরি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। থানার সাধারণ ডায়েরি নং ৯/৩৪৬।
ওই মামলার আসামিরা হলেন—ধোলায়খাল মালিক সমিতির কার্যকরি সভাপতি মাসুদ রানা, তার বাবার নাম আব্দুল আলী। তিনি নারিন্দার ১৯ দক্ষিণ মুসন্দিতে থাকেন। দ্বিতীয় জন ঢাকা জেলা ট্রাক, ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি জয়নাল আবদিন। তার বাবার নাম আব্দুর রশিদ। তিনি ধোলায়খাল ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকায় থাকেন। আর তৃতীয় জন একই সমিতির কোষাধ্যক্ষ আব্দুল জব্বার। তার বাবার আলীম উদ্দিন। তিনিও ধোলায়খাল ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকায় থাকেন। এর মধ্যে মাসুদ রানা স্থানীয় কাউন্সিলর সারোয়ার হোসেন আলোক খুবই ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে। সে কারণে পুলিশ তাকে ধরছে না বলেও অভিযোগ শ্রমিক ফেড়ারেশনের। তাদের দাবি, পুলিশ এই নেতাদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এর সঙ্গে আর কারা জড়িত, তাদের নাম বেরিয়ে আসবে।
এদিকে আন্দোলনে পোড়া মোবিল হামলার অভিযোগে ফেড়ারেশন থেকে বহিষ্কৃত শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতেই ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক দ্বন্দ্বকে আন্দোলনের সঙ্গে মিলয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়ালের চেষ্টা করছে শ্রমিক ফেড়ারেশন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিয়নে বর্তমান কোষাধ্যক্ষ-আব্দুল জব্বার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যারা এসব অভিযোগ করছেন, তারাই আন্দোলনে চালক, যাত্রী ও শিক্ষার্থীদের গায়ে-মুখে পোড়া মোবিল মেখেছেন। আমরা এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলাম। আমরা পণ্যপরিবহন ধর্মঘট করেছি। আমরা কেন মোবিল মাখবো?’ তার অভিযোগ—‘যারা আমাদের বহিষ্কারের কথা বলছে তারা আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ী এলাকায় গেলে শ্রমিকদের হামলার শিকার হয়। কারণ শ্রমিকরা আন্দোলন চায় না। তারা আন্দোলন করতে বাধ্য করার চেষ্টা করে। চালকদের মুখে পোড়া মোবিল মাখার চেষ্টা করে। পরে শ্রমিকদের হামলা শিকার হলে তারা এখন হামলাকারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলছে।’
কোষাধ্যক্ষ-আব্দুল জব্বার বলেন, ‘ওয়ারী থানায় যে মামলাটি হয়েছে, সেটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মামলা।’
ফেড়ারেশনের নেতারা বলছেন, যারা ধর্মঘট ও ফেড়ারেশনের নেতাদের বিরুদ্ধে ছিলেন, তারাই এই হামলা করেছেন। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার স্পষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফেড়ারেশনের অন্তর্ভুক্ত ঢাকা জেলা ট্রাক, ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
পরিবহন ধর্মঘটের সময় যাত্রী-শিক্ষার্থী-চালকের মুখে পোড়া মোবিল মাখানোসহ কান ধরে ওঠবোস করার সঙ্গে যাদের সন্দেহ করছে ফেড়ারেশন, তারা হলেন—ধোলায়খাল মালিক সমিতির নেতা মাসুদ, ঢাকা জেলা ট্রাক, ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি জয়নাল আবেদিন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলতাব হোসেন ও বর্তমান ক্যাশিয়ার আব্দুল জব্বার। এই শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে ফেডারেশনের অভিযোগ, তারা আন্দোলনে উসকানি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের অভিযোগ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেড়ারেশনের অধিকাংশ নেতা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একটি স্বার্থন্বেষী মহল লোকও জড়িত। তারা দেশকে অচল করতে এবং সরকারের উন্নয়ন কাজকে বাধা দিতে সরকারের শেষ মুহূর্তে সংসদ নির্বাচনের আগে এমন কর্মবিরতি আহ্বান করে সরকার ও জনগণকে জিম্মি করে ফায়দা লুটতে চেয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফেড়ারেশনের শীর্ষ নেতাদের বুঝতে হবে, তাদের সংগঠনের অধিকাংশ নেতাই বিএনপি-জামায়াতপন্থী। তারা ধর্মঘটে তাণ্ডব চালিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তারা জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছেন। দেশকে অচল করার চেষ্টা করেছেন। ফেডারেশনের নেতাদের উসকানিতেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে বাইরের কোনও শ্রমিক জড়িত নন। এর সব দায় ফেডারেশন তাদেরই নিতে হবে।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ফেড়ারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘ধর্মঘটের যাত্রী-শিক্ষার্থীদের মুখো পোড়া মোবিল লাগানো ও কান ধরে ওঠবোস করানোর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে পেরেছি। দুই জনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারও করেছি। আরও বেশ কিছু লোক এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তাদের বিষয়ে পুলিশকে জানিয়েছি। পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আসল অপরাধীরা ধরা পড়বে।’
দুই শ্রমিক নেতাকে সাংগঠনিক দ্বন্দ্বের কারণে বহিষ্কারের অভিযোগ প্রসঙ্গে ওসমান আলী বলেন, ‘যারা ফেডারেশনবিরোধী, তারাই এসব ঘটাচ্ছেন।’