আমার নিউজ ডেক্স:
বাংলার প্রকৃতি বরাবরই বৈচিত্র্যতায় পরিপূর্ণ। ষড়ঋতুর এই দেশে একেক ঋতু একেক রূপ নিয়ে বাংলাদেশকে মায়ার আবেশে জড়িয়ে রেখেছে। তাইতো শীত মানেই এখানকার হাওড়-বাওড়, খাল-বিল, নদ-নদী ও জলাভূমিগুলো ভরে উঠে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির কলকাকলিতে। বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখি প্রতিবছর বা একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর বা কোন নির্দিষ্ট ঋতুতে একটি অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে আসা যাওয়াকে পাখি পরিযান বলে। মূলত যেসব প্রজাতির পাখি পরিযানে অংশ নেয় তাদেরকে পরিযায়ী পাখি বলে। পাখি পরিযানের অন্যতম দুটি প্রধান কারণ হচ্ছে খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং বংশ বৃদ্ধি। সাইবেরিয়া অথবা এন্টার্কটিকার তীব্র শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি পাড়ি জমায় সমুদ্রবর্তী দক্ষিণের দেশসমূহে যেখানে শীতের তীব্রতা তুলনামূলক কম। বাংলাদেশ, ভারত এবং মিয়ানমারের অনেক এলাকায় আশ্রয় নেয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এসব পরিযায়ী পাখি কিছু নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থেকে পুনরায় তাদের গন্তব্যে চলে যায় বলেই এরা অতিথি পাখি নামে আমাদের দেশে পরিচিত। সাধারণত অক্টোবর থেকে নভেম্বরে দল বেধে ঝাঁকে ঝাঁকে এসব পাখি আসে এবং শীতকালের পর মার্চ-এপ্রিল পুনরায় চলে যায় আপন ঠিকানায়। বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি পাখির আগমন ঘটে বাংলাদেশে। এসময় সাধারণত উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অঞ্চল ও হিমালয়ের কিছু এলাকায় শীতের প্রকোপ এবং তুষারপাতের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি চলে আসে খাদ্য ও বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। তথ্যানুসারে পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ লক্ষ প্রজাতির পাখি রয়েছে। শুধু ইউরোপ এবং এশিয়ায় প্রায় ছয়শত প্রজাতির পাখি রয়েছে আর এরা প্রতি বছরই শীতকালের অতিথি হয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। নর্দান পিনটেইল, বালি হাঁস, বুনো হাঁস, হেরণ, গ্যাডওয়াল, রাজহাঁস, জলপিপি, চিতি, সরালি, নর্থ বিরিয়া, বৈকাল সহ প্রভৃতি এমন আরও বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বিচরণ দেখা যায় বাংলার খাল-বিল, হ্রদ, হাওড় বাওড় গুলোতে। হাকালুকি হাওড়, টাঙ্গুয়ার হাওড়, বাইক্কাবিল, চলনবিল সহ অন্যান্য হাওড়, বিল ও জলাভূমিতে অতিথি পাখির সমাগম লক্ষ্য করা যায় ।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এসব পাখির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এরা বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যকে করেছে সমৃদ্ধ এবং তা পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। শীতে এসব মনোমুগ্ধকর অতিথি পাখিদের দেখবার জন্য দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে দর্শণার্থী। পাখিদের মুখরিত কলতানে প্রকৃতি এক অপার লীলাভূমির রূপ ধারণ করে। কিন্তু কালের আবর্তনে ক্রমশ অতিথি পাখির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। অবৈধভাবে অতি মাত্রায় পাখি শিকার, বৃক্ষ নিধন, নদী, খাল-বিল সহ বিভিন্ন জলাভূমি ভরাট, শস্য উৎপাদনের জন্য কীটনাশকের ব্যবহার ও রাসায়নিক বর্জ্য নিঃসরণের ফলে সৃষ্ট বায়ু ও পরিবেশ দূষণের ফলে অতিথি পাখির সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। যার দরূণ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পোকা মাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ফসল উৎপাদনও ব্যহত হচ্ছে যা পরিবেশের বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের উপর ব্যাপক ক্ষতি সাধনের জন্য দায়ী। এরফলে চলনবিল, টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ দেশের অন্যান্য জলাভূমিতে অতিথি পাখির আগমন পূর্বের তুলনায় বহুগুণে হ্রাস পেয়েছে। এভাবে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে পড়ছে এবং এর প্রভাবে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তাই জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য অবৈধ পাখি শিকার ও বিক্রয় এবং অন্যান্য পরিবেশ দূষণ বিরোধী কাজ রোধের আইন প্রণয়ন ও গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকার ও সর্বসাধারণকে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে সুরক্ষিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের যা সচেতনতার মাধ্যমেই আমরা তা মোকাবিলা করতে পারি। শাহ ইসরাত আজমেরী: এমফিল ফেলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।