এস.এম আকরাম হোসেন :
‘ও প্রতিদিন আমাকে মারতো। পাটা-পুতার পুতা দিয়ে আঘাত করতো, যাতে কেউ মারধরের আওয়াজ না পায়। আমার সারা শরীর থেতলে গেছে ওই আঘাতে। আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আত্নহত্যার। কিন্তু সেই সুযোগও পায়নি। আমি সেখান থেকে জীবিত ফিরে আসতে পারবো সে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।’ এক বখাটে যুবকের বন্দীদশা থেকে ফিরে এসে সোমবার রাতে এভাবেই বলছিলেন মানিকগঞ্জ জেলা জজকোর্টের আইনজীবি কামরুন্নাহার সেতু।
‘প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেয়াই ওর কাজ। ও যে কত নারীর জীবন নষ্ট করেছে, কতো মানুষকে পথে বসিয়েছে- তা ও নিজেই বলতে পারবে না। ও প্রথমে নারীদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে। নানা প্রলোভনে ফেলে তাদের অন্তরঙ্গ মেলামেশার ভিডিও ধারণ করে। নিয়ে নেয় মোবাইল ফোন, আইডি কার্ড কিংবা অন্য কোন পরিচয়পত্র। তারপর তাকে জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। না দিলেই শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন।’
আর এইসব অপরাধ ঢাকতে সে পুলিশসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে। নিজেকে অনেক বিত্তশালী ও বড় মাপের ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে খুব সহজেই মিশে যায় তাদের সাথে। ব্যবহার করে প্রাইভেট কার।রাজধানীর মতিঝিলে জনি টাওয়ারে নাকি তার ফ্ল্যাট আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তার বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার আজিমনগরে। নাম মো. শাওন মিয়া, বয়স আনুমানিক ৪০। তবে সে একেক সময় একেক নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে। তার ফেসবুক আইডি থেকে নেয়া ছবি দিয়ে তার প্রকৃত নাম ঠিকানা শনাক্তের চেষ্টা চলছে। এমনকি তার ফেজবুক আইডিতে দেখা যায় সরকার দলীয় মানিকগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ছবি রয়েছে। সেতু বলেন, আমার সামনেই মানিকগঞ্জের অনেক প্রভাশালী রাজনৈকিত নেতাদের সাথে ফোন দিয়ে কথা বলতেন। বিয়ের পর এক নেতার বাড়ীতে সে আমাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ওই নেতা তাকে একটি সাবান ও শাওনকে একটি গেঞ্জি উপহার দেন। সে নিজেকে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক পরিচয় দিত।
জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে মানিকগঞ্জে আসার পর অ্যাডভোকেট কামরুন্নাহর সেতু জানান, তার বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের ঢাকুলী গ্রামে। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর তিনি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী পড়ুয়া ছেলে মোরশেদকে নিয়ে তিনি তার বাবার বাড়িতে থাকেন। তিনি ২০১৩ ও ২০১৪ সালে মানিকগঞ্জ জেলা আইনজীবি সমিতির নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে সদস্য হন। স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগে তার সাথে শাওন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আচরণে সমস্যা থাকায় তিনি তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেন।
‘গত ৯ সেপ্টেম্বর সে আমাকে নিয়ে আমার বোনের শ্বশুরবাড়ি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের করচাবাঁধা গ্রামে বেড়াতে যায়। সেখানে ওই দিন অপিরিচিত এক ব্যক্তিকে কাজী দেখিয়ে আমার ও আমার বোনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাবিন নামায় স্বাক্ষর নেয়। এরপর সেখান থেকে আমি আমার বাবার বাড়ি ফিরে আসি। আসার পথে সে বলে, এখন তুমি আমার বিয়ে করা বউ। আমার কথার বাইরে গেলে বিপদ আছে। উকালতি বাদ দিতে হবে। আর বিয়ের কথা কাউকে বলতে নিষেধ করে। মান সম্মানের ভয়ে, আমি কাউকে কিছু বলি নাই।’
‘গত ১৭ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জজকোর্ট থেকে কথা আছে বলে সে আমাকে তার প্রাইভেট কারে উঠিয়ে নবীনগর কহিনুর গেটের তুনু হাজীর ৬ তলা বাড়ির ৪ তলার একটি কক্ষে নিয়ে যায় এবং সেখানে আমাকে স্ত্রী হিসেবে রাখে। অজানা-অচেনা জায়গায় একটি কক্ষে বন্দী থেকে আমি ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ি।’
সেখানে প্রথম দুদিন তার সাথে ভাল ব্যবহার করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৩য় দিন তার মানিকগঞ্জ ডাকঘরে থাকা কয়েকটি হিসেব থেকে তাকে টাকা উঠিয়ে দিতে বলে। তার কাছে অস্ত্র আছে, ভয়ে তিনি তাকে ৫ লাখ, ১০ লাখ এবং ১ লাখ করে ৩বার উঠিয়ে দিতে বাধ্য হন। এর দুদিনপর সে তার কাছে আরো টাকা চায়। তার কাছে আর সঞ্চিত টাকা নেই জানালে সে তাকে তার নামে থাকা জমি লিখে দিতে বলে। তিনি তাকে জমি লিখে না দেয়ায়, তার ওপর শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। তার কাছ থেকে নিয়ে নেয় মোবাইর ফোন, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স। তারপর তাকে বিবস্ত্র করে নগ্ন ভিডিও ধারণ করে এবং তার শেখানো কথা বলিয়ে তারও ভিডিও রেকর্ড করে। সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়ি দেয়ার হুমকী দেয়।সারাদিন তাকে ওই কক্ষে আটকে রেখে মারধর করতে থাকে। ঘরের মধ্যে থাকা পাটা-পুতার পুতা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। এতে তার মুখমন্ডলসহ বিভিন্ন অংশ থেতলে যায়।
সবশেষ গত ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে তাকে জানে মেরে ফেলার হুমকী দেয়। জানে বাঁচতে তিনি তার কক্ষের জানালা খুলে এক প্রতিবেশীকে রাতে না ঘুমিয়ে একটু সজাগ থাকতে বলে। তাকে বাঁচাতে আকঁতি জানায়। রাত দুইটার দিকে তাকে মারধর শুরু করে। জবাই করতে রান্না ঘর থেকে বটি আনতে গেলে সে আর্ত চিৎকার শুরু করে। তার আর্তচিৎকারে প্রতিবেশীরা ঘরের দরজায় নক করলে দরজা খুলে সে প্রতিবেশীদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে। সে বলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাইরের লোকের কোন কথা থাকতে পারে না। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ণ এবং আর্তচিৎকারে বাড়ির মালিক এসে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে পৃথক একটি কক্ষে রাখেন।
উভয়ের পরিবারের লোক ছাড়া তাকে দেয়া হবে না জানালে, সে বাড়ির মালিকসহ প্রতিবেশীকে অনুরোধ করে বলে সে নিজেরই সেতুকে তার বাবার বাড়িতে দিয়ে আসবে। তার কথায় বিশ্বাস করে তার কাছে সেতুকে তুলে দেয় তারা। কিন্তু সে সেতুকে মানিকগঞ্জের দিকে না এসে সে ঢাকার দিকে রওয়ানা দেয়। সে প্রাইভেট কারে বসে বিভিন্ন যায়গায় ফোন করে তাদের ঢাকার ধানমন্ডি ল্যাবএইড হাসপাতালে এসে থাকতে বলে। সে তাকে অস্ত্রের ভয় দেখায় এবং কথা না শুনলে মেরে ফেলার হুমকী দেয়। সে সেতুকে ওই হাসপাতালে নিয়ে একজন চিৎিসককে একটি কেবিন দিতে বলে। কেবিনে নিয়ে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। এটা বুঝতে পেরে সেতু সেখানে থেকে চলে আসতে চাইলে তাকে সেখানে মারধর শুরু করে। এই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে খবর দিলে সে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। ভীত সন্ত্রস্ত ওই নারী আইনজীবী হাইকোর্টে তার এক পরিচিত আইনজীবিকে ফোন দিয়ে এই ঘটনা বলে। পরে সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে নেয়া হয় হাইকোর্টে।
ঢাকার উত্তারায় তার এক পরিচিত ব্যক্তির বাসায় রবিবার রাত্রিযাপনশেষে সোমবার রাতে তিনি সেখান থেকে সরাসরি মানিকগঞ্জ থানায় এসে তিনি তার ১৫ দিনের বিভিষীকাময় ঘটনার বর্ণনা দেন।
কামরুন্নাহার সেতুর পিতা মো. সফিউদ্দিন বলেন, তার মেয়ে নির্খাঁজ হওয়ার পর ওই যুবক তার কাছে ফোন করে তার মেয়েকে দিয়ে ৫ লাখ টাকা চায়। না দিলে তাকে হত্যা করার হুমকী দেয়। তিনি ৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জ থানায় ওই যুবকের বিরুদ্ধে একটি অপহরণ মামলা করেন।
মানিকগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি তদন্ত) মো. হানিফ সরকার বলেন, ওই নারী আইনজীবিকে তার বাবার করা অপহরণ মামলায় উদ্ধার দেখিয়ে তার মৌখিক বক্তব্য রেকর্ডের জন্য তাকে মানিকগঞ্জ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। তিনি ইচ্ছে করলে আলাদা মামলাও করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
অভিযুক্ত মো. শাওন মিয়ার দুটি মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।