শীতের প্রকোপে মানুষের জবুথবু অবস্থা। গত কয়েকদিন ধরে শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার দাপটে সারা দেশে কোথাও সূর্যের আলো পড়েনি। শীতের তীব্রতা বাড়ায় ঠান্ডাজনিত রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। শীতের কারণে সর্দিজ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা, অ্যালার্জি, চোখ ওঠা, ডায়রিয়া রোগীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত ২৪ ঘণ্টায় শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় ৫ হাজার মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব জীবাণু তাপমাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত শীতকালে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ও মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়। ফলে এ সময় মানুষ বিশেষ ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলোটাইসিস, ব্রংকিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থাইটিস, চামড়ার শুষ্কতা অন্যতম। এসব রোগ থেকে সুরক্ষায় শীত এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর শীতের তীব্রতা বেশি। স্বাভাবিক শীতকালীন রোগ-ব্যাধির পাশাপাশি তীব্র শীতে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি বেশি। তিনি বলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেই মানুষের শরীরের তাপ উৎপাদন ক্ষমতা কমতে থাকে। তীব্র শীতে বয়স্কদের ক্ষেত্রে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীর শরীর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসে। শরীরে তাপ উৎপাদন কম হওয়ায় হাত-পা কুঁকড়ে যায়। এমনকি শরীর অবশ হয়ে আসতে থাকে। এ ছাড়া হাঁপানি, ডায়রিয়া, সর্দি-কাশিসহ অন্যান্য রোগত আছেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ২৯৬টি উপজেলা থেকে প্রাপ্ততথ্যে দেখা গেছে, এ সময়ে প্রায় ৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার জন, এআরআই-এ (অ্যাকিউট রেসপারেটরি ইনফেকশন) আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৯৯৭ জন ও অন্যান্য রোগে (জন্ডিস, আমাশয়, চোখের প্রদাহ, চর্মরোগ ও জ্বর) চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৯৯২ জন।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গত কয়েকদিনে শিশু রোগীরা শ্বাসতন্ত্র ও ডায়রিয়া সমস্যা নিয়ে আসছেন। অনেক শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তন এবং তীব্র শীতের কারণে এ দুটি রোগে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের শিশু বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকা থেকে শিশুদের নিয়ে অভিভাবকরা হাসপাতালে এসেছেন। রোগীদের মধ্যে শূন্য থেকে ৮ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যাই বেশি। তাদের অধিকাংশেরই শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। সাধারণত বয়স, বাতাসের গতি, কুয়াশার প্রকোপ, সূর্যের কিরণকাল ইত্যাদির ওপর শীতের অনুভূতি নির্ভর করে।
এ প্রসঙ্গে রাজধানীর ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. ফেরদৌস আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, শীতের সময়ে বৃদ্ধ ও শিশু উভয়ের ক্ষেত্রে শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। কারণ এ দুই বয়সের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। শীতে শিশু ও বৃদ্ধদের অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রংকিউলাইটিস, নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত গরম কাপড়সহ হাত-পায়ে মোজা পরিয়ে রাখতে হবে। কোনোভাবেই ঠান্ডা লাগানো যাবে না। গোসলসহ সবক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে।
ঢাকার সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত দুই সপ্তাহে হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে গেছেন নতুন-পুরাতন ২১৩৭ জন শিশু ও বয়স্ক রোগী। এ ছাড়া সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত কয়েকদিনে প্রায় ১৫৫০ শিশু ও বয়স্করা চিকিৎসা নিচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে।
আশুলিয়ার নারী ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপপরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় চারজন নারী ও সাতজন শিশু শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত চিকিৎসা নিতে শিশুদের অভিভাবকরা হাসপাতালে ভিড় করছেন। আমরা পর্যাপ্ত চেষ্টা করছি রোগীদের সু-চিকিৎসার দেওয়ার জন্য। কয়েকটি জেলার সর্বশেষ শীত পরিস্থিতি জানিয়েছেন আমাদের
নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা
লালমনিরহাট : ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় কাবু হয়ে পড়েছে লালমনিরহাটের মানুষ। গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩০ শিশু। সব থেকে কষ্টে পড়েছেন বৃদ্ধ, শিশু, প্রতিবন্ধীরা।
পঞ্চগড় : দেশের সর্ব উত্তরের প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড়ে শীত ও শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে রোগ বালাই। গত চারদিন ধরে এই জনপদের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শৈত্যপ্রবাহের কারণে দুর্ভোগে পড়ছে জেলার সর্বস্তরের মানুষ। গত ১৭ দিনে বহির্বিভাগ থেকে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে গেছে নতুন, পুরাতন মিলে ১৪৯৮ জন নারী-শিশু ও ১৩২৫ জন পুরুষ রোগী।
মাগুরা : জেলায় শীতের প্রকোপে ডায়রিয়া ও কলেরাসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। শীতের শুরু থেকে প্রতিদিন ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৫০-২০০ শতাধিক রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রোববার মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে বেড সংখ্যা ১০টি। বেড সংখ্যা কম হওয়ায় কষ্টের মধ্যে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে রোগীদের। এ ছাড়া শিশু ওয়ার্ডের মেঝেতে রেখে শিশু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মাগুরা সদর হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক জয়ন্ত কুন্ড বলেন, মাগুরা ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে ঠান্ডাজনিত কারণে শিশু রোগীর চাপ একটু বেশি।
বরিশাল : জেলায় বাড়ছে শীতজনিত রোগ। জেলা প্রশাসন ছিন্নমূলদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। শনিবার সন্ধ্যায় ৫০০ কম্বল বিতরণ করার কথা নিশ্চিত করেন জেলা প্রশাসক অজিয়র রহমান। বরিশাল আবহাওয়া অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল হালিম সময়ের আলোকে জানান, গত দুদিনের তাপমাত্রা ছিল অসহনীয় পর্যায়ে।
চুয়াডাঙ্গা : জেলায় রোববার সকাল ৬টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড করা হয়েছে ৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গায় শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে। রোববার তাপমাত্রা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
অভয়নগর : যশোরের অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন অনেক শিশু ও বৃদ্ধ ঠান্ডাজনিত রোগে যেমন ডায়ারিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, হুপিংকাশিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম : জেলা প্রশাসন থেকে ৫১ হাজার কম্বল বিতরণ করা হলেও শীতে আক্রান্ত প্রায় ৬ লাখ প্রান্তিক মানুষ চরম ভোগান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এখন পর্যন্ত তেমন একটা সাঁড়া মেলেনি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সংগঠনগুলো থেকে।