মানিকগঞ্জের মোঃ ইজাজ আহমেদ এলিন(৩৮)। ধামরাই পৌর এলাকার দক্ষিণ তালতলা মহল্লার বাসিন্দা দোতলা বাড়িতে নিজের পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছিলেন। বাড়িটির নিচতলায় আবিদ টেলিকম নামে তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তে শুরু করে।
সর্বশেষ শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি জানতে পারেন কুয়েতে থাকা তার মা ও বোনকে দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে বাসায় থাকা স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে ইজাজের পরিবারে নেমে এসেছে শোকের মাতম। এ ঘটনায় কুয়েত পুলিশের পক্ষ থেকে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
নিহতরা হলেন- মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার সুলতানঞ্জ এলাকার হলেও বর্তমানে ঢাকার ধামরাইয়ের পৌর এলাকার দক্ষিণ তালতলা মহল্লার মুক্তিযোদ্ধা মৃত আব্দুল মান্নান শিকদারের স্ত্রী মমতা বেগম (৫৬) এবং তার মেয়ে স্বর্ণালতা (৩২)।
সরেজমিনে ধামরাইয়ের দক্ষিণ তালতলা এলাকায় গিয়ে নিহত মমতাজ বেগমের একমাত্র ছেলে মো. ইজাজ আহমেদ এলিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯০ সালে তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান শিকদার মারা যাওয়ার পর ২০০০ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার সুলতানঞ্জ গ্রাম থেকে সপরিবারে ধামরাই পৌর এলাকার দক্ষিণ তালতলা মহল্লায় এসে বসতি গড়েন। এর আগে তার মা মমতাজ বেগম ১৯৯৫ সালে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে সরকারি ভিসায় কাজের জন্য কুয়েতে পারি জমান। তার বদৌলতে ধীরে ধীরে পরিবারটি সচ্ছল হতে শুরু করে এবং সবাই মিলে সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছিলেন। গত আড়াই বছর আগে তার ছোট বোন স্বর্নালতাও (৩২) কাজের জন্য কুয়েতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইজাজ বলেন, প্রতিদিনই মায়ের সঙ্গে আমরা ২-৩ ঘণ্টা কথা বলতাম।
আমার মা দেশে আসার জন্য সকলের জন্য কেনাকাটা করে রেখেছিলেন এবং ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকাও উত্তোলন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে করোনার কারণে তিনি আর দেশে আসতে পারেননি। গত মঙ্গলবার দুপুরেও মায়ের সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকেই মা ও বোনের মোবাইল বন্ধ পাই। পরে আমি কুয়েতে থাকা অন্যান্য স্বজন ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে আমার মায়ের বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেও কোন সহযোগিতা পাইনি। সর্বশেষ শুক্রবার সন্ধ্যায় দুর্গন্ধ বের হলে সেখানকার পুলিশ ঘরের তালা ভেঙে মা ও বোনের রক্তাক্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে।
হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত উল্লেখ করে ইজাজ বলেন, আমার মায়ের অনেক স্বর্ণালংকার ছিল। এ ছাড়া দেশে পাঠানোর জন্য কয়েক দিন আগে ১০ লাখ টাকা উঠিয়েছিলেন আমার মা। যারা আমার মাকে হত্যা করেছে তারা ব্যাংক থেকে টাকা ওঠানোর পর থেকে আমার মায়ের পিছু নিয়েছিল এবং টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটপাটের জন্য মা ও বোনকে এভাবে খুন হতে হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
মা-বোনের হত্যার সুষ্ঠু বিচারের পাশাপাশি দ্রুত তাদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে ইজাজ বলেন, এখনো মা-বোনের লাশ পাইনি কিন্তু বর্তমানে আমি নিজের জীবন নিয়েই শঙ্কায় আছি।
মমতা বেগমের মা সালেহা বেগম বলেন, গত কয়েক দিন ধরে কাঁদতে কাঁদতে নাতিটার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। একসঙ্গে মা ও বোনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় ছেলেটি। শুক্রবার সেখানকার প্রবাসী এক বাংলাদেশির সঙ্গে স্বর্নলতার বিয়ে হওয়ারও কথা ছিল।
ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সামিউল হক বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। সরকারি নিয়মনীতি মেনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিহতদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, আমরা নিহতের স্বজনদের সঙ্গে তাদের বাসায় গিয়ে কথা বলেছি। যদি তারা কোন ধরনের শঙ্কায় থাকে তাহলে বিষয়টি আমাদের অবহিত করলে তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, শুক্রবার কুয়েতের জেলের আল সুখা এলাকার নিজ বাসা থেকে বাংলাদেশি মা ও মেয়ের রক্তাক্ত মৃতদেহ উদ্ধার করেছে কুয়েত পুলিশ। এ ঘটনায় সেখানকার পুলিশ একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে