গ্রীক পুরাণে আছে, ট্রয় রাজপুত্র টিথোনাস যখন দেবী অরোরার প্রেমে পড়েন তখন তাকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয় অমরত্ব। একসময় প্রেমিকা অরোরা মারা যান, অন্যদিকে টিথোনাসের যৌবন যায় ফুরিয়ে, বার্ধক্য তাকে গ্রাস করে। তিনি প্রার্থনা করতে থাকেন মৃত্যুর জন্য। কিন্তু দেবতার উপহার তো ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই।
টিথোনাসের মৃত্যু হয় না, তবে তিনি অচল, উপেক্ষিত, অপ্রয়োজনীয় ও অসহায় মানুষে পরিণত হন। দেবতার উপহার অভিশাপে পরিণত হয় তার জন্য।
চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে প্রবীণ মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভাঙছে যৌথ পরিবার, কমছে পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের কদর ও মর্যাদা, উপেক্ষিত হচ্ছে সন্তানদের কাছ থেকে পিতা-মাতার প্রয়োজনীয় সেবা ও ভালোবাসা প্রাপ্তি। এই নাগরিক বিছিন্নতা, উপেক্ষা আর আত্মসর্বস্ব জীবন যেন আধুনিক কালের টিথোনাসের যাতনার বাস্তবরূপ।
যারা পরিবারের বয়োবৃদ্ধ সদস্য এবং বৃদ্ধ বাবা-মাকে অবহেলা করে, অশ্রদ্ধা করে, বোঝা মনে করে, তাদের বোঝা উচিত একদিন তাদেরও টিথোনাসের মতোই বার্ধক্য আসবে, শরীর অচল হবে, তারাও উপার্জনে অক্ষম হবেন। তাদের সন্তানরাও তাদের সঙ্গে একই আচরণ করতে পারে! যে কারণে পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, সম্মান করা, তাদের খোঁজ-খবর, প্রয়োজনের দিকে নজর রাখা– এটি সহস্র বছরের পুরাতন সামাজিক প্রথা এবং ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে সভ্য সমাজে স্বীকৃত। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশে আইন করে পিতামাতার ভরণপোষণ করাকে আইনি কর্তব্যও করা হয়েছে। কর্তব্য পালন না করলে রয়েছে শাস্তির বিধান।
বাংলাদেশেও ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩’ নামে একটি আইন কার্যকর আছে। এই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তার মা-বাবার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ্য এখানে “ভরণ-পোষণ” অর্থ শুধু খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধাকে বুঝানো হয়নি বরং বাবা-মাকে ‘সঙ্গ’ প্রদান করাও ‘ভরণপোষণ’ এর সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়েছে।
কোনো মা-বাবার একাধিক সন্তান থাকলে সে ক্ষেত্রে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করবে। এই আইনানুযায়ী সন্তান মানে শুধু পুত্র নয়, কন্যারাও অন্তর্ভুক্ত। এই আইনের ধারা ৩ (৭) অনুযায়ী কোনো পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সঙ্গে বসবাস না করে পৃথকভাবে বসবাস করলে, সেক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাঁর দৈনন্দিন আয়-রোজগার, বা ক্ষেত্র মতো, মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা, বা ক্ষেত্র মতো, উভয়কে নিয়মিত প্রদান করতে হবে।
এ আইনের ৩ ধারায় আরো বলা হয়, কোনো সন্তান তার বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তার বা ক্ষেত্র মতো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। তা ছাড়া সন্তান তার মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে।
৪ ধারা অনুযায়ী, এ আইনের মাধ্যমে বাবার অবর্তমানে দাদা-দাদি এবং মায়ের অবর্তমানে নানা-নানিরও ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন ২০১৩-এর ৫ ধারার (১) অনুযায়ী, যদি কোনো সন্তান এই আইন লঙ্ঘন করে তাদের এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, স্বামী, তাঁদের পুত্র-কন্যা কিংবা অন্য কোনো নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে ভরণপোষণের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় তাহলে উক্ত আইনের ধারা ৫(২) অনুযায়ী তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবে, ফলে তারাও একই শাস্তির মুখোমুখি হবে।