স্টাফ রিপোর্টার:
পুরো কলেজটাকেই তিনি করে তুলেছেন ডিজিটালাইজড। সেখানে শিক্ষার্থীরাও এখন হাতে কোনো লেনদেন করে না। ফি বা বেতন পরিশোধ করেন নগদ বা বিকাশে। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হাজিরা দেয় শিক্ষার্থীরা। চেষ্টা করা হয় কলেজে শতভাগ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার। এমন নানা পদক্ষেপ নেয়ার কারণেই জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০২০-এ দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. রেজাউল করিম।
১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজেই পড়াশোনা করেছেন অনেক গুণী ও মেধাবী মুখ। বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে সেই ধারা। গত বছর এ কলেজের ৫০০ শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। গত বছরের মার্চে সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন রেজাউল করিম। প্রায় এক বছরের এ সময়টুকুতে যা যা করেছেন তার ওপরই মূল্যায়ন করে সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান নির্বাচিত হন তিনি।
১৩টি মানদণ্ড বিবেচনায় রেখে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান নির্বাচন করা হয়। সেগুলো হলো শিক্ষাগত যোগ্যতা, ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের ওপর প্রভাব এবং অভিভাবক ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্ব, সততা ও সুনাম, প্রশাসনিক দক্ষতা ও আর্থিক শৃঙ্খলা, অনলাইনে বিদ্যালয়ের শ্রেণী কার্যক্রম ও দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, পেশাগত বা গবেষণামূলক সৃজনশীল প্রকাশনা, আইসিটি বিষয়ে দক্ষতা ইত্যাদি। রেজাউল করিম বলেন, সেক্ষেত্রে কিছু বিষয় আছে যেগুলো আগেই অর্জন করেছি। অধ্যক্ষ হওয়ার পর বাকি কাজগুলো করি। চূড়ান্ত মূল্যায়নে সবার চেয়ে বেশি স্কোর পাওয়ার ফলে সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান নির্বাচিত হই।
রেজাউল করিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর বদলে গেছে দেবেন্দ্র কলেজের বেশকিছু বিষয়। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনাকাল আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, আইসিটি ও ডিজিটালাইজেশন ছাড়া আগামীর পৃথিবীতে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। তাই আমি পুরো কলেজ সিস্টেম ডিজিটালাইজড করার ওপর গুরুত্ব দিই। আমাদের শিক্ষার্থীরা হাতে কোনো লেনদেন করে না। নগদ ও বিকাশের মাধ্যমে তারা বেতন, ভর্তি ও পরীক্ষার ফিসহ যাবতীয় লেনদেন করে। তাদের যাবতীয় রেকর্ড অনলাইনে সংরক্ষিত আছে। রেজাল্ট, পরীক্ষার মূল্যায়নপত্র, এমনকি সিটি পরীক্ষার নম্বরও তারা অনলাইন থেকে নামিয়ে নিতে পারে। কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষা না দিলে বা বেতন বকেয়া থাকলে খুব সহজেই তা জানা যায়।
আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলি, যেখানে রোবটের আধিপত্য থাকতে হবে। সে যুগে আইসিটিতে দক্ষরাই নেতৃত্ব দেবে। তাই শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে আইসিটি শিক্ষার বিকল্প নেই বলেই মনে করেন এ শিক্ষক। তিনি বলেন, আমরা নিজস্ব উদ্যোগে শিক্ষকদের আইসিটি ট্রেনিং করিয়েছি। সরকারি ক্রয় বিধিমালা বিষয়ে ট্রেনিং করিয়েছি। শুধু তা-ই নয়, আমাদের এ মফস্বলের কলেজেও ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে অনলাইন শিক্ষার আওতায় আনতে পেরেছি। কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে না এলে বা তার কোনো সমস্যা থাকলে আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে, মিটিং ডেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছি। আমার লক্ষ্য ছিল শতভাগ শিক্ষার্থীর হাজিরা নিশ্চিত করা।
শুধু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাই নয়, শ্রেণীকক্ষেও বেশ পরিবর্তন এনেছেন এ শিক্ষক। করেছেন সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রমও। বণিক বার্তাকে তিনি জানান, আমাদের শিক্ষার্থীরা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হাজিরা দেয়। প্রতিটি শ্রেণীকক্ষ সিসিটিভি মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস মাল্টিমিডিয়া-সমৃদ্ধ। শেখ রাসেল কম্পিউটার ল্যাবের পাশাপাশি কলেজের নিজস্ব দুটো কম্পিউটার ল্যাব আছে। দুটো সায়েন্স ল্যাব আছে। কমনরুমে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট চালানোর সুবিধা রয়েছে। বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করছে। সায়েন্স ক্লাব, ডিবেট ক্লাব, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, দেয়াল পত্রিকা—এ বিষয়গুলো নিয়মিত করছি আমরা। এতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটছে। প্রতি মাসে একবার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সামাজিক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করি। সেখানে এইডস, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা হয়।
২০১৯ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শ্রেণী শিক্ষক নির্বাচিত হন রেজাউল করিম। তখন তিনি ফরিদপুরে অবস্থিত সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। প্রতিষ্ঠান চালানোর কিছু নিজস্ব কৌশল আছে এ শিক্ষকের। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এখনো নিয়মিত ক্লাস করাই। ইকোনমিকসের ছাত্র হওয়ার সুবাদে আমি ইকোনমিকসের ক্লাসে চলে যাই। সিসিটিভি তো আছেই, একটি টিমও আছে শিক্ষকদের ক্লাসে উপস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য। এর পরও আমি প্রতিদিন সকালে অথবা দুপুরের এক সময় ক্লাস মনিটরিংয়ে বের হই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমস্যা থাকলে সেটি শুনি, সমাধানে ব্যবস্থা নিই।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন তিনি। রেজাউল করিম জানান, দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে কখনো টিউশনি করাইনি। আসলে টিউশনি পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে প্ররোচিত করে। আমাদের এখানেও শ্রেণী কার্যক্রম চলাকালে কোনো শিক্ষক টিউশনি করতে পারবেন না বলে লিখিত নোটিস দিয়েছি এবং এটি মানাও হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা গাইড থেকে পড়াকে নিরুৎসাহিত করি। কোনো শিক্ষার্থী যদি পরীক্ষার খাতায় গাইড থেকে লেখে শিক্ষকরা সেটি শনাক্ত করেন এবং এ বিষয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন।
এর আগে ঢাকা কলেজেও পড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু শহরের তুলনায় মফস্বলে শিক্ষকতাকে অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং মনে করেন এ শিক্ষক। বিশেষ করে মানিকগঞ্জে দরিদ্র শিক্ষার্থী বেশি। এদের অনেকেই ঢাকায় চলে যায়। কারণ তারা সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি উপার্জনেরও সুযোগ পায়। এটা একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয় মফস্বলের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য।
দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের মুকুট অর্জন হয়েছে। দেশের মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে দেবেন্দ্র কলেজের নাম। কিন্তু এখনো বেশকিছু সমস্যার মুখে পড়ে রয়েছে কলেজটি। রেজাউল করিম বলেন, আমাদের বড় সমস্যা ট্রান্সপোর্ট। ২৫ হাজার শিক্ষার্থী আমাদের, কিন্তু কোনো যানবাহন নেই। আসলে বাজেটে শিক্ষা নিয়ে বরাদ্দ থাকার কথা জিডিপির ৬ শতাংশ। বর্তমানে আছে ২ শতাংশেরও কম। ফলে এককভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোয় বরাদ্দ খুবই কম হয়। আমাদের কলেজের মৌলিক আরেকটি সমস্যা হলো ছাত্রাবাসের অভাব। একটি ছাত্রাবাস ছিল, সেটি এখন সংস্কারাধীন। দুটো ছাত্রীনিবাস থাকলেও আরো বেশি দরকার। আরেকটি বড় সমস্যা হলো শিক্ষকের অভাব। আদর্শ মান অনুযায়ী ২৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকা দরকার। আমাদের এখানে ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক মাত্র ১০১ জন। এটি আমাদের প্রধান মৌলিক সমস্যা।