আপনি থামবেন। আপনাকে থামতে হবে। আপনার সামর্থ্য, আপনার শক্তি, আপনি আপনার সম্পর্কে সব জানেন, সব বোঝেন। কখন থামবেন সেই সিদ্ধান্তটাও আপনিই নেবেন। সেই নিষ্ঠুর সময়টা চলেই এলো?
পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা চলে আপন ছন্দে, আপন গতিতে। কুলকিনারা থাকে না। থাকে না জীবনের গতিপথ। স্রষ্টার আশীষ, নিজের পরিশ্রম, নিবেদনের অসম্ভবকে তারা সম্ভব করেন। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকেন। শোকেসে যুক্ত হয় একের পর এক অর্জন। তাতে ধুলো পরে যায় ব্যর্থতায়। তারা হয়ে ওঠেন জীবনের আয়না। কিন্তু জীবনে এমন নিষ্ঠুর মোড় আসে যখন সব ভালোবাসা বিসর্জন দিতে হয়। সব মায়া ত্যাগ করতে হয়। নামের পাশে বসাতে হয় দাঁড়ি! পূর্ণচ্ছেদ করতে হয় প্রিয় জার্সি, প্রিয় জায়গা।
কাতার বিশ্বকাপ এমনই এক মঞ্চ যেখানে বাজছে পূর্ণচ্ছেদের সুর। তাতে অশ্রুসিক্ত বিশ্ব। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসি ও নেইমার জুনিয়র; বর্তমান সময়ের ফুটবল মাঠের তিন অমূল্য রত্ম। যাদের পায়ের জাদুতে বিশ্ব দোল খায়। পৃথিবী ওলট-পালট হয়। অথচ কাতার বিশ্বকাপ এই ত্রয়ীর জন্য হতে যাচ্ছে দাঁড়ি টানার মঞ্চ। জাতীয় দলের জার্সিতে হয়তো তাদের দেখা যেতে পারে। কিন্তু বিশ্বমঞ্চে, বিশ্বকাপ আসরে, দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে এটিই হতে যাচ্ছে তাদের শেষ পদচারণা।
এমন ঘোষণা ব্রাজিলের নেইমার সবার আগে দিয়েছেন। আর্জেন্টাইন সুপারস্টার মেসি কিছুদিন আগে বলে দিয়েছেন, এটাই শেষ বিশ্বকাপ। রোনালদো বাকি ছিলেন। সিআরসেভেন ঘোষণা দেননি। তবে ইংলিশ ও স্প্যানিশ গণমাধ্যম তার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের বরাত দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, এবারই পূর্ণচ্ছেদ।
ম্যাচের পর ম্যাচ, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস চোখ ধাঁধানো ফুটবল খেলেছেন ত্রয়ী। মুগ্ধতা ছড়ানো তাদের ফুটবল জ্ঞান, অসাধারণ তাদের ক্ষীপ্রতা, ড্রিবলিংয়ে তাদের ঐশ্বরিক প্রতিভা। তবুও ত্রয়ীর চিরকালীন শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন, রয়েছে কিন্তু। কারণ ওই একটাই, জাতীয় দলের জার্সিতে জেতা হয়নি বিশ্বকাপের মুকুট। এ নিয়ে রয়েছে তাদের ক্ষোভ, রয়েছে আক্ষেপ, রয়েছে হাহাকার। সেই হাহাকার কি এবার মিটবে কাতার বিশ্বকাপে?
চার-চারটি বিশ্বকাপ এরই মধ্যে খেলেছেন মেসি ও রোনালদো। নেইমার খেলেছেন তিনটি। তিন জনের মধ্যে মেসিই কেবল শিরোপার খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিলেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার। কিন্তু জার্মান শ্রেষ্ঠত্বে কপাল পোড়ে জাদুকরের। নেইমারের ব্রাজিল ওই সালেই খেলেছে সেমিফাইনাল। জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হওয়া ম্যাচে নেইমার দলের বাইরে ছিলেন। কিন্তু সেটিই ছিল বিশ্বকাপে তার সর্বোচ্চ অবস্থান।
রোনালদোর অবশ্য বিশ্বকাপ শুরুই হয়েছিল দারুণভাবে। ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে তার দল খেলেছিল সেমিফাইনাল। ফ্রান্সের কাছে সেমিফাইনালে হারের পর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষেও পারেনি পর্তুগাল। ফলে চারেই শেষ তার যাত্রা।
দেশের জার্সিতে তিন জনই মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা জিতেছেন। নেইমার ও মেসির শোকেসে এরই মধ্যে উঠেছে কোপা আমেরিকার শিরোপা। রোনালদোও জিতেছেন ইউরোর শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। এসব জিততেও কম ঘাম ঝরাতে হয়নি তাদের। তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে একটাই স্বপ্ন একটাই লক্ষ্য বিশ্বকাপের শিরোপা জয়। বিশ্বকাপে মেসি-রোনালদো-নেইমারের পারফরম্যান্স হলো: মেসি ২০০৬ থেকে ২০১৮ চার বিশ্বকাপে ১৯ ম্যাচ খেলেছেন। গোল করেছেন ৬টি। অ্যাসিস্ট করেছেন ৫টি। এর মধ্যে তিনি শুধু ২০১০ বিশ্বকাপে কোনো গোল পাননি। রোনালদো একইভাবে গত চার বিশ্বকাপে ১৭ ম্যাচ খেলেছেন। তিনি প্রতি আসরেই গোল পেয়েছেন। তার মোট গোল ৭টি। অ্যাসিস্ট করেছেন ২টি। অন্যদিকে নেইমার ২০১৪ থেকে ২০১৮ দুই আসরে ১০ ম্যাচে গোল করেছেন ৬টি। অ্যাসিস্ট করেছেন ৩টি।
তিনজনের মধ্যে বয়সে এগিয়ে রোনালদো। বয়স ৩৭ পেরিয়ে গেছে। ফুটবলে এমন বয়সে খেলা ছেড়ে দেন অনেকেই। কিন্তু ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এই বয়েসেও যেন টগবগিয়ে ফুটছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফিটনেস থাকায় চলতি বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম দাবিদার তিনি। পর্তুগাল ফুটবল দলের অনেকেই বলছেন কাতার বিশ্বকাপ তারা রোনালদোর জন্য খেলতে চান। শুধু খেলতেই নয়, নকআউট পর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্য পর্তুগালের।
২০০৬ সালের বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলা পর্তুগাল এবার কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের অধীনে শিরোপা ঘরে তুলতে চায়। এই কোচের অধীনেই ২০১৬ সালে ইউরো জিতেছিল পর্তুগাল। ২০১৯ সালে জিতেছিল ইউরোপীয় নেশনস লিগ। এবার বিশ্বকাপে চোখ রোনালদোর।
বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনা রয়েছে চূড়ান্ত ফর্মে। ৩৫ ম্যাচে তারা অপরাজিত। মেসিও দলের মতো অপ্রতিরোধ্য। নিয়মিত গোল করছেন। গোল বানিয়ে দিচ্ছেন। পিএসজির পাশাপাশি আর্জেন্টিনার জার্সিতেও একের পর এক অনবদ্য পারফরম্যান্স করছেন। জাতীয় দলের হয়ে শেষ তিন ম্যাচে করেছেন ৯ গোল।
গত বছর কোপা আমেরিকা জিতেছিলেন মেসি। ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়েছে তার দল। বিশ্বকাপ যদিও সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রতিযোগিতা। যে প্রতিযোগিতায় ২০১৪ সালে ফাইনাল খেলেছিলেন মেসি। কিন্তু সেবার জার্মানির কাছে হেরে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ীর ট্রফি শোকেসে তার; কার্যত সমস্ত ট্রফিই রয়েছে। তাই মেসি ভক্তদের আশা দেশের হয়ে শেষ বিশ্বকাপে ট্রফিটা জিতুন এই মহাতারকা।
ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার যতটা সামর্থবান, যতটা প্রতিভাবান তার ছিঁটেফোটাও বিশ্বমঞ্চে দেখাতে পারেননি। ২০১৪ এবং ২০১৮ দুটি বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্স গড়পড়তা। অথচ ওই সময়ে নিজের সেরা সময় কাটাচ্ছিলেন নেইমার। মাঠের বাইরের নানা বিতর্ক সব সময় তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। মাঠের ভেতরে তার অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু তার ফুটবল মস্তিস্ক বরাবরই ক্ষীপ্র, তার স্কিল অন্য সবার চেয়ে আলাদা। শরীরে ব্রাজিলিয়ান রক্ত বহমান। তাই কোনো কিছুর থেকে তাকে আড়াল করা যাবে না। অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পথ দেখাতে পারেন। পথহারা জাহাজ নিয়ে যেতে পারেন গন্তব্যে। তার উপস্থিতিতে ব্রাজিলের হেক্সা মিশন সফল হলেও হতে পারে। যদি এমনটা হয় তাহলে অমরত্বের স্বীকৃতিই পেয়ে যাবেন নেইমার। কখনো ব্যালন ডি’অর না জেতা নেইমারের জন্য এই শিরোপাই হতে পারে জীবনের সব।
খুব কাছে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা স্পর্শ করার সুযোগ পাননি মেসি, রোনালদো, নেইমার। হয়তো বা সেই ট্রফিরই অপূর্ণতা থাকবে, সেটি সর্বকালের এই সেরাদের হাতে উঠতে পারেনি বলে! কাতার বিশ্বকাপে কি অপূর্ব চিত্রনাট্যটি লেখা হবে? তিনজনের একজন পেলেও যেন ফুটবলের অন্যরকম এক জয় দেখবে বিশ্ব।