প্রথম দিনেই আকাশ ছুঁয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন বড়। চারদিকে আলোচনা, কে এই রহস্যময় স্পিনার? বাংলাদেশ তবে পেতে চলেছে একজন সুনীল নারাইন! কিন্তু না, ছয় দিনের মধ্যে রহস্যময়ী স্পিনার আলিস আল ইসলাম দেখে ফেলেছেন মুদ্রার ওপিঠ। গায়ে চাকিংয়ের কালিমা, ভাগ্য দেবী যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, যোগ হয় দুর্বিষহ ইনজুরি।
আলিসের লড়াই শুরু হয়, কিন্তু থেমে যান না, বিশ্বাস হারান না। মাঝে চলে যায় চার বছর। ছিলেন আরেকটি সুযোগের অপেক্ষায়। ২০২৪ সালের দশম বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স সেই সুযোগ এনে দেয়। আলিস সুযোগ পান, লেখেন প্রত্যাবর্তনের অসাধারণের কাব্য। মাত্র ১৩০ রান করা কুমিল্লা জয় এনে দেন ৭৯ রানের! ৪ উইকেট নেন মাত্র ১৭ রান দিয়ে। আলিসের প্রত্যাবর্তনের গল্প যেন হাল ছেড়ে দেওয়া মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার। ধাপে ধাপে সেই গল্পই সাজানো হলো রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য।
হ্যাটট্রিকে উত্থান
২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি। বিপিএলে ঢাকা ডায়নামাইটসের নেট বোলার থেকে একাদশে সুযোগ পান আলিস। বাজিমাত করলেন বিপিএল অভিষেকেই। রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে প্রথম ম্যাচে চলে আসেন আলোচনায়। শেষ পর্যন্ত এই ম্যাচে আলিস ২৬ রান দিয়ে নেন ৪ উইকেট। হন ম্যাচ সেরা।
উত্থান ডেকে আনলো পতন
রহস্যময়ী স্পিনার হিসেবে প্রথম ম্যাচে নজর কেড়ে নেন আলিস। কিন্তু উত্থানের সঙ্গে আলিসের পতনের ঘণ্টা-ধ্বনিও বেজে ওঠে। তার বিরুদ্ধে ওঠে চাকিংয়ের অভিযোগ। অদ্ভূত বোলিংয়ের জন্য আম্পায়াররা তার বিরুদ্ধে চাকিংয়ের অভিযোগ আনে।
চাকিংয়ের সঙ্গে ইনজুরি, আলিসের মাথায় হাত
১২ জানুয়ারি অভিষেকে হ্যাটট্রিক। একই দিনে চাকিংয়ের অভিযোগ। ছয় দিনের মাথায় আলিস পড়েন হাঁটুর এসিএল ইনজুরিতে। এমন অবস্থা হয় তাকে সতীর্থরা কোলে নিয়ে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যান। একদিকে চাকিংয়ের অভিযোগ আরেকদিকে ইনজুরি; আলিস যেন উদয় হতেই ডুবতে বসেছেন।
অবতার হয়ে আসেন খালেদ মাহমুদ সুজন
মাত্র ছয় দিন। এর মধ্যে আলিস শূন্য থেকে মাটিতে নেমে এসেছেন। চাকিংয়ের অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে আলিসকে লড়তে হয় ইনজুরির সঙ্গে। খালেদ মাহমুদ সুজন ঢাকা ডায়নামাইটসের মাধ্যমের অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করে দেন। প্রায় ৮ মাস লাগে এই ইনজুরি থেকে সেরে উঠতে।
ইনজুরি মুক্ত হয়েও নেই স্বস্তি, গায়ে চাকিংয়ের তকমা
ইনজুরি না হলে আরও আগেই চাকিংয়ের অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারতেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) তত্বাবধানে ২০১৯ সালের নভেম্বরে হয় চাকিংয়ের পরীক্ষা। চারদিনের ব্যবধানে ফল আসে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন আলিস। চাকিংয়ের কোনো কিছু পায়নি বিসিবি!
এবার মাঠে ফেরার লড়াই, কিন্তু ফিরতে পারেন না
২০২০ সালে আবার বিপিএল খেলেন আলিস। কিন্তু আগের ধার নেই। চাকিংয়ের অভিযোগ আর ইনজুরি আলিসের মনোবল ভেঙে দিয়েছে। ২ ম্যাচ খেলেই বাদ। আবার ফিরে আসে ইনজুরি। সঙ্গে দেশে আসে মহামারি করোনা। আলিসকে পেছনে ঠেলে চার বছরের জন্য!
চাকিং মুক্ত হলেও ইনজুরি পিছু ছাড়ছে না
একই ইনজুরি ফিরে আসে বারবার। কখনো ১ মাস বাদে, কখনো ২ মাস। কিন্তু হাল ছাড়েন না। একে তো ইনজুরি, তার উপর বোলিংয়ে আগের মতো ধার নেই। দুর্বল হয়ে পড়ে এক পা। আলিস অসহায় হয়ে পড়েন। ধৈর্য্য ধরে লড়তে থাকেন ইনজুরির সঙ্গে।
এক দুপুরে প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখা শুরু
একদিন দুপুরে ঘরে বসে হঠাৎ করে নতুন অ্যাকশনে বোলিংয়ের কথা ভাবতে থাকেন আলিস। যেই ভাবা সেই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে বোলিংয়ে নেমে পড়েন। হয় না, হয় না। ১ মাস সময় চেয়ে নেন নিজের কাছে। এর মধ্যে হলে করবেন, না হলে আগের অ্যাকশনে চলে যাবেন। ১ মাস পেরিয়ে যায়, তবুও অ্যাকশন হয় না। আরও সময় নেন, এবার অ্যাকশন হয়ে যায় নিজের চাওয়া মতোই।
এগিয়ে আসেন গুরু সালাউদ্দিন
আলিসের অ্যাকশন ঠিক। এবার কি করবেন? স্থানীয় কোচ হুমায়ুন কবির শাহীন আলিসকে নিয়ে যান মাস্কো সাকিব ক্রিকেট একাডেমিতে। সালাউদ্দিন অ্যাকশন দেখে, রেখে দেন নিজের কাছে। অ্যাকশন ঠিক, বোলিংয়ে লাইন-লেন্থ ঠিক নেই। শুরু হয় কাজ। ডাক পান প্রিমিয়ার লিগে সালাউদ্দিনের দলে। কিন্তু ম্যাচ পান না।
সুযোগ আসে কিন্ত কাজে লাগাতে পারেন না
২০২৩ সালে আবারও প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবে সুযোগ পান আলিস। কিন্তু কাজে লাগাতে পারেন না। ৫ ম্যাচে নেন ৬ উইকেট। বোলিংয়ে যে এখনো আগের ধারটা নেই। আলিস আরও কাজ করতে থাকেন বোলিং নিয়ে। ধীরে ধীরে ক্ষুরধার হতে থাকে।
হারিয়ে যাওয়া রহস্য আবার ফিরে আসে
আলিস হাল ছাড়েন না। নিজের উপর বিশ্বাস ছিল পারবেন। সেই বিশ্বাস থেকে কাজ করে যান সালাউদ্দিনের সঙ্গে। দুই মাস আগে ইনজুরি মুক্ত হয়ে শতভাগ ফিট হন। আসে বিপিএলের দশম আসর। এবার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স আলিসের আলাদিনের চেরাগ! লিটন দাস-ইমরুল কায়েসদের কথায় আলিসকে দলে নিয়ে নেন সালাউদ্দিন। দেশ সেরা এই কোচ নিজেও জানতেন, আলিস পারবে। কিন্তু একা কিছু করতে চাননি। লিটন-ইমরুল বলায় সালাউদ্দিন সুযোগ পেয়ে যান আলিসকে দলে নেওয়ার। আলিস পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ।
পাশে ছিল না বিসিবিও
নিজের অর্থে আলিস চার বছর ধরে লড়ে যান ইনজুরির সঙ্গে। পরিবারের সমর্থন, নিজের বিশ্বাস আর সালাউদ্দিনের সঙ্গে কাজ আলিসকে ফিরিয়ে আনে আগের রূপে। পাশে ছিল না বিসিবি কিংবা কোনো সতীর্থ। খোঁজও নিতেন না তারা। সবাই ধরে নিয়েছিল আলিস ফিনিশড। আলিস শুধু ছিলেন একটি সুযোগের অপেক্ষায়। সেই সুযোগ কাজে লাগান দারুণভাবে।
এখন আর স্বপ্ন দেখেন না!
ক্যারিয়ারের শুরুতে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। চাকিং-ইনজুরি সে সব স্বপ্ন মেরে ফেলেছে। এখন আর কোনো স্বপ্ন দেখেন না। তবে হ্যাঁ, শুধু আসল কাজটা করে যেতে চান। নিজের বোলিংয়েই দেবেন যত মনোযোগ, বাকি সব হয়ে যাবে এমনিতে, স্বপ্নরাও এসে ধরা দেবে।