নিজস্ব প্রতিবেদক:
স্বার্থপরতা, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার এই সমাজে জোবায়ের রহমান নাজিউল (১৮) একেবারেই ব্যতিক্রম। তাই তো জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও বাঁচাতে গিয়েছিলেন শিশুসহ ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে যাওয়া নারীকে। শেষ পর্যন্ত ওই নারীর সঙ্গে মারা যান জোবায়েরও। বেঁচে যায় শিশুটি। তবে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হলেও মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন এই তরুণ।
ঘটনাটি ঘটছে সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিক গাইবান্ধা শহরের আদর্শ কলেজসংলগ্ন মাঝিপাড়া এলাকায় রেললাইনে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সান্তাহার থেকে পার্বতীপুরগামী পদ্মরাগ ট্রেন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাঝিপাড়া অতিক্রম করছিল। এ সময় শহরের কলেজপাড়ার গৃহবধূ রাজিয়া বেগম তাঁর দেড় বছরের শিশু আবিতকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিচ্ছিলেন। তাঁদের বাঁচাতে গিয়ে ওই গৃহবধূর সঙ্গে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা যান কলেজ শিক্ষার্থী জোবায়েরও।
জোবায়েরের এমন মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ এলাকাবাসী শোকে কাতর। নাজিউলের বাড়ি অর্থাৎ গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী গ্রামে রাতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে চৌকির ওপর পড়ে আছে জোবায়েরের নিথর দেহ। সবাই তাঁর বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীসহ উপস্থিত সবার চোখে পানি।
জোবায়েরের মায়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশ। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘আমার কলজার ধনকে আনে দেও। আমার ধনকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম। আহা রে ধনটা কই গেল। ভালো করে লেখাপড়া করবে, সেজন্য শহরে ভালো স্কুলে ভর্তি করালাম। মাসে মাসে এখন আমি কাকে টাকা পাঠাব। কে আমাকে বলবে, মা আমার মেসের খাবার ভালো লাগছে না। এখন আমি কাকে নিয়ে বেঁচে থাকব। বাবারে, তুই ক্যামনে কবরে একাই থাকবু। আমাক একা করে এভাবে চলে যাবি।’
ভরতখালী গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলামের ছেলে জোবায়ের রহমান। জাহিদুল ইসলামের দুই ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। নাজিউল গাইবান্ধা শহরের এস কে এস স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
এদিকে নিহত গৃহবধূ রাজিয়া বেগমের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গাইবান্ধা শহরে গোবিন্দপুর মাঝিপাড়ায়। চার বছরের প্রেমের সম্পর্কে তিন বছর আগে এই গ্রামের রবিয়ার রহমানের ছেলে আনোয়ার হোসেনের (২৫) সঙ্গে বিয়ে হয় সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বাগলির বাজার গ্রামের বাবরের মেয়ে রাজিয়া (২৩)। দেড় বছর আগে তাঁদের আবিত নামের একটি ছেলেসন্তান হয়। সেই সন্তানকে কোলে নিয়ে আত্মহত্যা করতে রেললাইনে যান রাজিয়া বেগম।
প্রতিদিনের মতো সোমবার সকালে প্রাইভেট পড়ার জন্য মেস থেকে বের হয়েছিলেন জোবায়ের। রেললাইনের পূর্ব পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সিজার নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী মর্মান্তিক ঘটনাটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, একটি ছেলে কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছিল। হঠাৎ দেখতে পায়, সান্তাহার থেকে ছেড়ে আসা পদ্মারাগ ট্রেনটি টানা হুইসেল দিচ্ছে আদর্শ কলেজসংলগ্ন মাঝিপাড়া এলাকায় আর এক নারী কোলে থাকা শিশু সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছেলেটি দৌড়ে তাঁদের কাছে যায়। এরই মধ্যে ট্রেনটি সেখানে পৌঁছে গেলে ছেলেটি কোলের সন্তানসহ নারীকে সরানোর জন্য টানাটানি শুরু করে। তার পরই জোবায়ের ও রাজিয়াকে ধাক্কা দেয় ট্রেনটি। তারা দুজন গুরুতর আহত হলেও শিশুটি তেমন আঘাত পায়নি।
স্থানীয়রা তিনজনকেই গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক জোবায়ের ও রাজিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন। আর শিশুটিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরিবারের কাছে দিয়ে দেন।
গোবিন্দপুরের মাঝিপাড়ায় রাতে গিয়ে দেখা যায়, শিশুটি খেলা করছে তার দাদি মঞ্জুরি রানীর কোলে। নিহতের বড় জা মনি আকতার বলেন, গত রোববার রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। রাজিয়া একপর্যায়ে তাঁর নিজের ঘর থেকে বের হয়ে এসে বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাঁদের ঘরে ছোট আবিতকে মারধর নিয়েই মূলত এই কলহ। এর আগেই রাজিয়া দুই-তিনবার রেললাইনে মাথা দিয়ে মারা যাওয়া জন্য গিয়েছিলেন।
রাজিয়ার স্বামী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ছেলেকে আমার স্ত্রী মারে সব সময়। গত রাতে এর জেরে স্ত্রীকে মারধর ও গালি দিই। এরপর রাতেই ঘর থেকে আমার স্ত্রী বের হয়ে যায়। পরে আমার ছেলেসহ অন্য রুমে ঘুমায়। সকালে আমি কাজে যাই। পরে সাড়ে ১১টার দিকে শুনতে পাই আমার স্ত্রী ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা গেছে। আমি এই ছোট শিশুকে নিয়ে তার মা ছাড়া কীভাবে বেঁচে থাকব! আমার শিশুকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখছেন, নাজিউর রহমান নামে ছেলেটি বাঁচলে তার বাবা-মায়ের কোল খালি হতো না।’
এদিক জোবায়ের এমন মৃত্যুর মাধ্যমে শিশুকে বাঁচানোর বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে মৃত্যুঞ্জয়ী আখ্যা দিচ্ছেন।
কবি ও সাংবাদিক রজতকান্তি বর্মণ তাঁর ফেসবুকের স্ট্যাটাসে লিখছেন, জোবায়েরের জন্য আমরা গর্বিত। ওর বাবা-মাকে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না। প্রিয় সন্তান জোবায়েরকে হারানোর অভাব কেউ কোনো দিনই ওর বাবা-মাকে পূরণ করে দিতে পারবে না। কিন্তু জোবায়েরকে নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। সেটি হলো, আমাদের কিশোর, তরুণ সমাজ এখনো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে, পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়ায়নি। আমরা আশান্বিত হতেই পারি, সমাজে এখনো জোবায়েরের মতো কিশোররা আছে, যারা নিজের সমূহ সর্বনাশ হতে পারে জেনেও মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
জোবায়ের রহমানের বন্ধু মাশনুন স্নিগ্ধ লিখেছেন, ‘আহ জীবন! আমার সহপাঠী, এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শুরু থেকে যার সাথে ওঠাবসা, ওরে আজ হারাইলাম; অন্যকে বাঁচাইতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় সে নিজে চলে গেল না ফেরার দেশে। এই তো আজকে সকাল ৯টা ১৫ পর্যন্ত একসাথে ছিলাম ভাই। কত গল্প করলাম, কেমিস্ট্রি প্রাইভেট পড়লাম একসাথে, বাসায় আসতে না আসতেই এই খবর! আমি বাকরুদ্ধ। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুক, ভাই।’
এভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোবায়ের রহমান নাজিউলের মহত্ত্ব নিয়ে লিখছেন অনেকেই।
ছোট আবিত তার মায়ের ভালোবাসা, আদর-স্নেহ ছাড়াই বেড়ে উঠবে, সমাজে হয়তো একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। হয়তো সেভাবে উপলব্ধিও করতে পারবে না নাজিউল নামের এক তরুণের জন্যই বেঁচে গিয়েছিল সে। কিন্তু নাজিউলের মা-বাবা কখনো ভুলতে পারবেন না ছেলের এভাবে চলে যাওয়া।
তবে মহাকাল সবকিছুকে ধ্বংস করে দিলেও কিছু কর্ম, ত্যাগ, সৃষ্টি কখনো বিলীন হয় না। তেমনি মহৎ কোনো কাজের মাধ্যমে মৃত্যুর পরও অন্যদের মনে অমর হয়ে থাকেন কিছু কিছু মানুষ। জোবায়ের রহমান নাজিউলও এমনই একজন।