কুরআন নাজিলের মাস রমজান; কুরআন নাজিলের রাত ‘শবে কদর’। এ রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কার জাবালে রহমত তথা হিরা পর্বতের গুহায় আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে ফেরেশতাদের সরদার হজরত জিবরাঈল (আ.) এর মাধ্যমে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (স.) এঁর প্রতি মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল কারীম নাজিলের সূচনা হয়।
আল্লাহ বলেন: ‘রমজান মাস! যে মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে মানবমণ্ডলীর দিশারীরূপে ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)।
এই রাতটি বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদাপূর্ণ রাত। এই রাত্রিকে আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’, ফার্সিতে ‘শবে কদর’ অর্থাৎ ‘কদর রজনী’ বা ‘ভাগ্যনিশি’ বলা হয়। কদর অর্থ সম্মানিত মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত, সম্ভাবনাময়, ভাগ্যনির্ধারণী।
আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাজিল করেছি মাহাত্ম্যপূর্ণ রজনীতে। আপনি কি জানেন সে মহিমাময় রাত্রি কি? মহিমান্বিত ঐ নিশি সহস৶ মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাত্রিতে ফেরেশতাগণ রূহুল কুদুস হজরত জিবরাঈল (আ.) সমবিব্যাহারে অবতরণ করেন; তাদের প্রভূ মহান আল্লাহ’র নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সকল বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে ঊষা লগ্ন পর্যন্ত।” (সুরা কদর)
আলী ইবনে উরওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বনি ইসরাঈলের চারজন আবেদ সম্পর্কে বলছিলেন, ‘তারা আশি বছর ধরে অনবরত আল্লাহর ইবাদাত করছিলো। বিখ্যাত এ চারজন আবেদ হলো আল্লাহর নবী হজরত জাকারিয়া (আ.), হজরত আইয়ুব (আ.), হজরত হিযকিল ইবনে আজূজ (আ.) এবং হজরত ইউশা ইবনে নূন (আ.)।’
এসব বর্ণনা শুনে সাহাবীগণ (রা.) রীতিমতো অবাক হলেন। এ সময় জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ (সা.)! আপনার উম্মতরা এ কথা শুনে অবাক হচ্ছে? তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা এর চেয়ে উত্তম কিছু রেখেছেন। এরপর তিনি সুরা কদর পাঠ করলেন। (তাফসীরে ইবনে কাসির)।
শবে কদরের ইবাদাতে ও প্রার্থনায় আপনার জীবন পরিবর্তন হতে পারে। আপনার ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে। জীবনে সকল অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হতে পারে। ব্যর্থতার অমানিশা দূর হয়ে সফলতার ঊষা উদয় হতে পারে। এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং বান্দাদের ডেকে ডেকে বলেন, ‘কে আছো প্রার্থী? প্রার্থনা করো আমি দান করবো; কে আছো আহ্বানকারী? দোয়া করো আমি কবুল করবো; কে আছো অসুস্থ আমার কাছে চাও আমি আরোগ্য দান করবো, কে আছো অভাবগ্রস্থ আমার কাছে চাও আমি প্রচূর্য দান করবো, কে আছো বিপদগ্রস্থ আমার কাছে চাও আমি বিপদমুক্ত করে দিবো। যা চাও আমি তাই দিবো। এভাবে বান্দার সকল প্রয়োজনের কথা বলতে থাকেন।’ (বুখারী: ১১৪৫, মুসলিম: ৭৫৮, মুসনাদে আহমাদ: ১৭৯১৫)
রমজাস মাস এলে রাসুল (সা.) বলতেন, ‘এ মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এই রাতের কল্যাণ থেকে বিরত হয়, সে প্রকৃতপক্ষেই হতভাগ্য।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৭১০৮; সুনানে নাসায়ি: ২১০৬)।
নবীজি (স.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রগুলোতে শবে কদর সন্ধান করো। (মুসলিম)। আরবীতে দিনের আগে রাত গণনা করা হয়। মুফাসসিরীনে কিরাম বলেন, আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয়ে নয়টি হরফ বা বর্ণ রয়েছে; আর সূরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয় তিন তিন বার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে বা নয়কে তিনবার যোগ করলে সাতাশ হয়, তাই সাতাশে রমজানে রাতে ‘শবে কদর’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। (তাফসীরে মাযহারী)। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের পঁচিশ, সাতাশ ও ঊনত্রিশতম রজনীতে শবে কদর তালাশ করো।’ (এই তিন রাতে মধ্যখানেও রয়েছে ‘সাতাশ’)। (মুসনাদে আহমাদ ও বুখারী)।
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (স.) বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় (আত্মমূল্যায়ন সহ) কদরের রাতে ইবাদাত করবে; তার অতীতের সকল গুণাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (বুখারি: ৩৪)। নবী (সা.) আরো বলেছেন; তুমি শবে কদরে এই বলে দোয়া প্রার্থনা করবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নী—হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করা পছন্দ করেন; সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, নাসায়ী, বায়হাকী)
শবে কদরে বেশি বেশি নফল ইবাদত (তাহাজ্জুদ, কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ, তসবি–তাহিল) করা, কবর জিয়ারত এবং দান খয়রাত করা। সিজদায় গিয়ে বা দুহাত তুলে কায়মনোবাক্যে নিজের জন্য, মা–বাবা–পরিবারসহ সমগ্র মানবজাতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা ও দোয়া করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি এবং বিশ্ববাসীর মুক্তি কামনা করা।