এস এম আকরাম হোসেন:
মানিকগঞ্জ পৌরসভার জয়রা রোড এলাকায় প্রায় দুই বছর আগে একটি ভাড়া ভবনে যাত্রা শুরু করে ‘মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতাল’ নামে একটি বেসরকারী শিশু হাসপাতাল। সরকারীভাবে অনুমোদন প্রাপ্তীর আগেই শিশু রোগী ভর্তি করে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ১০ জন শেয়ার হোল্ডার মিলে পরিচালনা হয়ে আসছে হাসপাতালটি। এই হাসপাতাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের শিশু চিকিৎসকেরা। যে কারণে শুরু থেকেই জমজমাট এই হাসপাতাল। অন্যান্য হাসপাতালে রোগী না থাকলেও এই ২০ শয্যার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৭৫ জন রোগী। সাধারণ রোগীদেরকে জিম্মি করে পর্দার অন্তরালে থেকে দেদারছে ব্যবসা করে যাচ্ছে শিশু চিকিৎসকেরা। তবে রোগীর তুলনায় হাসপাতালটিতে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স। হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে রোগীদের মাঝে রয়েছে নানা ক্ষোভ। দীর্ঘদিন ধরে এমন অনিয়ম চললেও হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। “মানিকগঞ্জ শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল” নামে অনুমোদন পেলেও হাসপাতালের সামনে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে “মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতাল” নামে।
সরেজমিনে যা পাওয়া গেলো
হাসপাতালে জয়রা এলাকার একটি বহুতল ভবনের নিচতলায় রয়েছে হাসপাতালটির রিসিপশন ডেস্ক। হাসপাতালের ডেস্কের সামনে শিশু রোগীর স্বজনদের প্রচন্ড ভীড় দেখা যায়। শিশুদের ভর্তি করানোর জন্য স্বজনদের দীর্ঘ সারি। নিচতলায় ঢুকতেই ডানপাশে রয়েছে একটি ফার্মেসি। তার ঠিক পরের কক্ষটিই আবাসিক চিকিৎসকের জন্য। ছোট্ট কক্ষটি দুটি চেয়ার ও একটি টেবিল নিয়ে কোনরকমে বসে রয়েছেন দু’জন চিকিৎসক। নিচতলাতেই রয়েছে প্যাথলজি সেন্টার।
দু’তলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত ভর্তি রোগীর শয্যা করা হয়েছে। চারতলায় পাশের একটি বিল্ডিংয়ের একটি ফ্লোর নিয়ে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সব মিলিয়ে হাসপাতালটিতে বেড রয়েছে ৭৫টি। এর মধ্যে সাধারণ শয্যা ৩১টি আর কেবিন সংখ্যা ২২টি। প্রতিটি কেবিনে আবার দুটি করে শয্যা রয়েছে। ৬ষ্ঠ তলার ক্যান্টিনের ফ্লোরেও দেওয়া হয়েছে বেড।
নিয়ম অনুযায়ী, ২০ শয্যার একটি হাসপাতালে ছয়জন চিকিৎসক ও ১২ জন ডিপ্লোমা নার্স থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ওই হাসপাতালে সরেজমিনে পাওয়া যায় মাত্র দুই জন চিকিৎসক। তাদের একজন ফাহিম আবরার মবিন। যিনি ঢাকা থেকে আসেন। সপ্তাহে ডিউটি করেন ৬০ ঘন্টা। অন্যজন হচ্ছেন ডা. তানজিলা ইসলাম। তিনিও প্রতি শিফটে অর্থাৎ সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টা ডিউটি করেন। হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী সর্ম্পকে জানতে চাইলে ডা. ফাহিম আবরার মবিন বলেন, শনিবার দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৫৫ জন রোগী। এসব বিষয় নিয়ে তিনি আর বেশি কিছু বলতে অনিহা প্রকাশ করেন।
মানিকগঞ্জ জেলা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের প্রধান গেট ঘেষে গড়ে উঠেছে ‘পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার’। সেখানকার দু’তলায় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নিয়মিত রোগী দেখেন প্রফেসর ডা. মো. নাছির হোসেন। ‘পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার’-এর কিছু লোক নিয়মিতভাবে অবস্থান করেন মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে। সেখান থেকে রোগীর স্বজনদেরকে ভুল-ভাল বুঝিয়ে ‘পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার’-এ নিয়ে আসেন নিয়মিত। এছাড়াও ডা. মো. নাছির হোসেনের রয়েছে আলাদা নাম-ডাক। প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক রোগী দেখেন তিনি। এসব রোগীদের বড় একটা অংশকে ভর্তির সুপারিশ করেন মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতালে। যে কারণে ওই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ভিড় লেগে থাকে সবর্ত্র। গত শনিবার ওই হাসপাতালের ভর্তি হওয়া প্রায় ২৩ জন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে আলাপ হলে তারা প্রত্যেকেই নাছির ডাক্তারের পরামর্শে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানান।
এছাড়া নবজাতক শিশুদের অপচিকিৎসার নামে অর্থ বাণিজ্যে ও হয়রানির অভিযোগ উঠেছে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাছির হোসেনের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেছে পলাশ নামের এক ভুক্তভোগী।
ভুক্তভোগী সরুপ আলী জানান, ডাক্তার নাছির হোসেনের ভুল চিকিৎসায় মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার উকুরিয়া গ্রামের সরুপ আলীর দেড় বছরের ছেলে এখন প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে।
আরোও বলেন, আমার দেড় বছরের ছেলের ঠান্ডা জ্বর দেখা দিলে আমি ডাক্তার নাছির হোসেনের কাছে নিয়ে যাই। তিনি আমার ছেলেকে তার প্রাইভেট মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। আমি আমরা সন্তানকে ৪ দিন ওই হাসপাতালে ভর্তি রাখি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে ডাক্তার নাছিরের ভুল চিকিৎসা আমার ছেলে এখন প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে। আমার ৪ দিনে ৪৫ হাজার টাকা বিল দিতে হয়েছে। কিন্তু আমার সন্তান ভালো করতে পারেনি।
এদিকে হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সেলিম মিয়া বলেন, হাসপাতালটি ২০ শয্যার অনুমোদনপ্রাপ্ত। তবে এর চেয়ে অনেক বেশি রোগী আজ ভর্তি রয়েছে, যা ঠিক হয়নি। তাই নিউজটি না করার অনুরোধ করেন তিনি।
তিনি আরোও বলেন, নাছির সাহেবের ডাইরেক শেয়ার নাই কিন্তু তার স্ত্রী আমাদের সাথে আছে। কর্ণেল মালেক মেডিকেল কলেজের শিশু ডাঃ হুমায়ুন কবিরের সাহেবের মালিকানার বিষয়ে তিনি বলেন তার কোন শেয়ার এখানে নাই, তবে তিনি কনসালটেন্ড হিসেবে এখানে আছে।
ডাক্তারদের রোগী পাঠানোর বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন। হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন না থাকার কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন যে সমস্ত কাগজপত্র দরকার আমরা ডিজিহেলথে পাঠাইয়া দিছি সেটা হইতেছে না। তবে যে কোন সময় হবে এবং পরিবেশ ও ফায়ারের লাইসেন্স এর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এবিষয়ে ডাক্তার নাছির হোসেন বলেন, আমি মানিকগঞ্জে ১৪ বছর যাবত রোগী দেখি। আমি তো আর সন্ত্রাসী মান্তান না যে জোর করে রোগীকে ভর্তি করব। ওষুধের কিছু এ্যাকশন রিএ্যাকশন থাকে। আমাকে বললে আমি ওষুধ চেঞ্জ করে দেই। কেউ চিকিৎসা নিয়ে প্রতিবন্ধী হবে এমন চিকিৎসা তো দেই না।
হাসপাতালের শেয়ারের কথা জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি শিকার করেন এবং হাসপাতালে রোগী পাঠানোর ব্যাপারে বলেন, অনেকেই তো শিশু হাসপাতালে চেম্বার করে। শিশু হাসপাতালে আমার যে রোগী আমি যে রোগী এখানে দেখি ধরেন যে রোগীগুলা গুরুতর এগুলারে আমি এডভাইস করি তাদের নিজস্ব অপসন আছে। কেউ হয়তো ভাল চিকিৎসার জন্য ওইখানে যায়। কারন ওইখানে রাউন্ডে ভাল ডাক্তার আছে তো অনেকে ওইখানে বেটার চিকিৎসার জন্য যায়। আর ওইখানে কাউরে তো বাধ্য করা হয়না।
এসব বিষয় জানতে যোগাযোগ করা হলে মানিকগঞ্জ কর্ণেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ডা: হুমায়ন কবির বলেন, ডা.নাছির হোসেন এবং তিনি এই হাসপাতাল ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন। ডা. নাছিরই মূলত হাসপাতালের মালিক। বাকি মালিকদের কিছুটা করে শেয়ার রয়েছে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতালে মূল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে ডা.নাছির এবং কর্ণেল মালেক মেডিকেল কলেজের ডা. হুমায়ন কবির। তারাই এই হাসপাতাল পর্দার অন্তরাল থেকে পরিচালনা করে আসছেন। আর বিভিন্ন সমস্যায় সামনে আসেন সেলিম মিয়া। যে কারণে হাসপাতালের রোগীর ভিড় লেগেই থাকে। ওই হাসপাতালে সব অনিয়মই নিয়ম।
মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাক্তার মো. মকসেদুল মোমিন বলেন,বিষয়টি আমি অবগত নই। যদি তার কাছে চিকিৎসা নিয়ে কেউ প্রতিবন্ধী বা হয়রানি হয়ে থাকে তাহলে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মানিকগঞ্জ শিশু হাসপাতালের অনিয়মের বিষয়ে খুজখবর নিয়ে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।