আমার নিউজ ডেস্ক,
‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি চলাকালে গত ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন গাড়িচালক খোকন চন্দ্র বর্মন। কাছ থেকে পুলিশের ছোড়া গুলিতে তার ওপরের ঠোঁট, মাড়ি, নাক, তালু-এগুলোর এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বলা যায়, সেখানে বড় একটি গর্ত হয়ে আছে। ২৩ বছর বয়সী এই তরুণের এক চোখ প্রায় বন্ধ। সে চোখে কিছু দেখেন না তিনি। আরেক চোখ কোনোভাবে টিকে আছে। তবে এ চোখেও আবছা দেখেন। তার দুই পায়ে রয়ে গেছে গুলি। এখন আয়নার সামনে খোকন তার চেহারা দেখে নিজেই ভয় পান। বর্তমানে তিনি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন।
চিকিৎসকরা ানান, খুব কাছ থেকে খোকনের মুখে ছররা গুলি মারা হয়েছে। গুলিতে তার মুখের একটি বড় অংশ হাড়সহ নষ্ট হয়ে গেছে। প্রথমে খোকনকে কৃত্রিম শ্বাসনালি দিয়ে নিশ্বাস নিতে হতো। বর্তমানে কৃত্রিম শ্বাসনালি খুলে দেওয়া হয়েছে। আগে নল দিয়ে তাকে তরল খাবার দেওয়া হতো। এখন মুখের গর্ত দিয়ে তরল খাবার একটু খেতে পারছেন। তার যে জটিল অবস্থা হয়েছে, এর চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়। তাই তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। খোকনের শুধু চিকিৎসাতেই কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা দরকার।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) এ ওয়ার্ডের ৯ নম্বর বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন ১৭ বছর বয়সী কিশোর মোস্তফা কামাল নূর। সাভারের জাহাঙ্গীর নগর কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সবার সাথে উৎসাহী হয়ে যায় আনন্দ মিছিলে। দুপুর ২টা ২৭ মিনিটে গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গেলে ডান বাহুর জয়েন্টে গুলি লাগে। সাথে সাথে তাকে এনাম মেডিকেলে নিয়ে অস্ত্রোপচার করে গুলো বের করলেও নার্ভ ছিড়ে এবং কার্ড ভেঙে অকেজে হয়ে যায় হাতটি। এরপর তাকে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে। এখানো নিয়মিত থেরাপি দিলেও চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করতে পারছে না। চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে তার এ চিকিৎসা সম্ভব নয়। তাকে দেশের বাইরে চিকিৎসা নেয়ার জন্য পাঠাতে হবে। দেশে এ অপারেশন করলে তার হাতটি চিরতরে অকেজো হয়ে যায়ার সম্ভবনা রয়েছে। শুধু গাড়িচালক খোকন চন্দ্র বর্মণ কিংবা কিশোর মোস্তফা কামাল নূর নয়, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে পায়ে, হাতে, চোখে বা শরীরের অন্য কোনো স্থানে গুলি লেগে আহত হয়ে এখনো রাজধানীর বিভিন্ন হসপাতালে প্রায় দেড় শতাধিক রোগী যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন। এদের মধ্যে ২০ জনের চিকিৎসা দেশে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাদেরকে দেশের বাইরে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া আরো দুজন চোখের রোগীকে দেশের বাইরে পাঠানোর ইচ্ছে থাকলেও বিশ্বের কোথাও এর চিকিৎসা না থাকায় বিদেশী চিকিৎসকের পরামর্শে সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়।
আন্দোলনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত রাজধানীর ছয় সরকারি হাসপাতালে মোট চিকিৎসা নিয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ। অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও গুরুতর আহত ১৪১ জনের চিকিৎসা এখনো চলছে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫ জন, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) ৫৭ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ জন, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ৪৫ জন, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৭ জন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে ৮ জন আছেন।
এদের মধ্যে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে ১৩ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪ জন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের ২ জন এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ১ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব করেছেন চিকিৎসকরা। এক্ষেত্রে আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই বোর্ড বসে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে নিটোর এর উপ-পরিচালক ডা. মো. বদিউজ্জামান ভোরের ডাককে জানান, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আহত হয়ে এ পর্যন্ত মোট ৪৮০ জন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে হাসপাতালের এ ও বি ওয়ার্ডে মোট ৫৭ জন রোগী ভর্তি আছে। কয়েকজনের অবস্থা ক্রিটিক্যাল। তাই উন্নত চিকিৎিসার জন্য আপাতত ১৩ জনকে দেশের বাইরে পাঠানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ৩০ অক্টোবর বিদেশি টিম আসার কথা রয়েছে। তারা দেখার পরে তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সহযোগি অধ্যাপক ডা. মাহফুজুর রহমান ভোরের ডাককে জানান, অন্দোলনের শুরু থেকে হাসপাতালটিতে ৫৩৬ চিকিৎসা নিতে এসেছেন। ৩৮১ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন এবং ১৫৫ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে ৮ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এদের মধ্যে ২ জনের অবস্থা জটিল হওয়ায় তাদের দেশের বাইরে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। সব কিছু ঠিক থাকলে থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভোরের ডাককে জানান, বর্তমানে হাসপাতালটিতে ১৫ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ৪ জনকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানোর কথা ভাবছি। সোমবার (আজ) বৈঠকের পর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা, খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, আন্দোলনে আহত হয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে মোট চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৭০০ জন। এর মধ্যে ৫০৪ জন ভর্তি হয়ে এক চোখে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর ২৫১ জন দ্বিতীয় ফেজে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বর্তমানে হাসপাতালটিতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৪৫ জন। াদের প্রত্যেের চোখের অবস্থাই খারাপ। এদের মধ্যে দুই জনকে বিদেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু বিদেশি চিকিৎসকরা আসার পর জানিয়েছেন এখানে যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, বিদেশেও এই চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাদের পাঠিয়ে কোন লাভ নেই। এজন্য উদ্যোগ নিয়েও থেমে যেতে হয়েছে। এদিকে গত শনিবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এক পোস্টের মাধ্যমে জানানো হয়, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য ১০টি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) এ সর্বমোট ২ হাজার ৫৩৩ জন আহত ছাত্র চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য আগমন করে। এর মধ্যে ৮৬৭ জন আহত ছাত্র চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং অবশিষ্টরা চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। আন্দোলনে আহত ছাত্রদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছে সেনাবাহিনী।
এ ছাড়া চিকিৎসাধীন ছাত্রদের প্রয়োজনীয় জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রদানে সর্বোচ্চ সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে তৎপর রয়েছে বলেও জানিয়েছে বাহিনীটি।