স্টাফ রিপোর্টার: মানিকগঞ্জের সিংগাইরে গ্রাহকের জামানতের শত কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা গ্রাম মানবিক উন্নয়ন ক্ষুদ্র সমবায় সমিতি নামক একটি সমবায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা বছরের পর বছর ঘুরেও পাচ্ছে না জামানতের আসল টাকা এবং লভ্যাংশ। প্রতারণার এই ফাঁদে পড়ে ভিটেমাটি হারা হয়েছেন অসংখ্য গ্রাহক। ঋণের ফাঁদে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে অনেকে।
আজ রবিবার (২৭ এপ্রিল) সকালে জামশা ইউনিয়নের উত্তর জামশা এলাকা অবস্থান ধর্মঘট ও মানববন্ধন পালন করে ভুক্তভোগী গ্রামবাসী। এ সময় বিক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সমবায় মালিক আমজাদ হোসেনের বসত বাড়িতে ভাঙচুর করে।
গ্রামের সাধারণ মানুষের সাথে এমন প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায় জামশা ইউনিয়নের দক্ষিণ জামশা এলাকার এই সমবায় প্রতিষ্ঠানটি। আশপাশের জামশা, জামির্তা, চারিগ্রাম, বলধারা, তালেবপুর এবং জয়মন্টপ ইউনিয়নের সহস্রাধিক গ্রাহক এই প্রতারণার ফাঁদে ভুক্তভোগী।
জানা গেছে, যৌথ মালিকানায় ২০০১ সালে সমবায় প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধিত হয়। জামশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুজ্জামান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক আমজাদ হোসেন, ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি মানিক মিয়া উজ্জ্বল ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুল্লাহ যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেন সমবায় সমিতিটি।
ফাতেমা আক্তার (৩৩) নামের এক ভুক্তভোগী দুই মাস মেয়াদে তিন বছর আগে রেখেছিলেন ১০ লাখ টাকা। জামানতের টাকার তিন বছর পার হলেও পাওয়া যায়নি কোন অর্থ। অর্থাৎভাবে আটকে আছে চিকিৎসা। যেকোনো সময় ঘটতে পারে মৃত্যুর মত ঘটনা। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘টাকা দেওয়ার পর থেকে তাদের পায়ে পর্যন্ত ধরেছি কোন টাকা দেয় নাই। আমার যা সহায় সম্বল ছিল সব শেষ। পোলাপান নিয়ে কিভাবে আমার দিন যায় রাত পোহায় আমি জানি আর আল্লাহ জানে। আমার পরিবারটারে একেবারে নিঃস্ব করে ফালাইছে।
গ্রাহকের শত কোটি টাকা পাচার করে দুবাইতে ব্যবসা শুরু করেছে এই চক্র পরিবারসহ যে কোন সময় চলে যাবে সেখানে এমনটাই জানিয়েছেন সেলিম মিয়া (৩০) নামের এক ভুক্তভোগী প্রবাসী। তিনি বলেন, ‘তারা গ্রাহকের টাকায় ব্যবসা করেছে কোথাও কোন লস খাইনি। পাবলিকের টাকায় পাবলিককে দিয়েছে। সমিতির ভাষ্যমতে তাদের ফিল্ডে কোটি পাঁচেক টাকা আছে কিন্তু তারা হাজার খানেক গ্রাহকের কাছ থেকে জামানত নিয়ে রেখেছে শত কোটি টাকা। তারা এই টাকা অবৈধভাবে দেশ থেকে পাচার করেছে। তাদের এই চক্রান্ত পূর্ব পরিকল্পিত।’
চারিগ্রাম এলাকার বাসিন্দা সাবিনা বেগম (৪৫) তার স্বামী এবং ছেলে দুজনেই প্রবাসী। ২০০৬ সালে ১০ লাখ টাকা এই সমিতিতে রাখেন। বছর দশেক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে দেড় শতাংশ হারে লভ্যাংশ পেয়েছেন। প্রয়োজনে ২০১৭ সালে তিনি মূল টাকা তুলে নেন। এরপর পুনরায় ২০১৮ সালে ১০ লাখ টাকা রাখেন সমিতিতে। দ্বিতীয়বার গচ্ছিত টাকা রাখার পর থেকেই শুরু হয় লভ্যাংশ পেতে তালবাহানা। এ বিষয়ে দফায়-দফায় গিয়েছেন অফিসে, গিয়েছেন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সকলের বাড়িতে। দেই দিচ্ছি করে কেটে গেছে আটটি বছর। এই টাকার জন্য সংসারে তৈরি হয়েছে অশান্তি।
এ সকল বিষয়ে অভিযুক্ত কাউকেই এলাকাতে পাওয়া যায়নি। তবে কথা হয়েছে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সমবায়ের পরিচালক গাজী কামরুজ্জামানের স্ত্রী মৌসুমী আক্তারের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘টাকা পয়সার জন্য বাড়িতে প্রতিনিয়তই লোকজন আসে। আমি আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি আট থেকে নয় কোটি টাকার কথা স্বীকার করেছেন যা গ্রাহক পায়। পর্যায়ক্রমে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনা পলানোর পর থেকে রাজনৈতিক মামলায় তিনিও গাঁ ঢাকা দিয়ে আছেন। সমিতির টাকাগুলো একাধিক জায়গায় ইনভেস্ট করা আছে। সেখান থেকে প্রফিট আসা শুরু হলে তিন থেকে চার বছরের ভিতর গ্রাহকের সব টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে।’
এ বিষয়ে জেলা সমবায় কর্মকর্তা ফারহানা ফেরদৌসী বলেন, ‘প্রথমত কোন সমবায় সমিতি গ্রাহকের কাছ থেকে জামানত সংগ্রহ করতে পারবেনা। সমিতির নিবন্ধন থাকলে সদস্যদের মাঝে ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম পরিচালিত করতে পারবে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা অভিযোগ করলে আমরা সমিতির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’