আমাদের চোখকে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষার্থে আমরা সানগ্লাস পরে থাকি। কিন্তু আমাদের অনেকেই এই বিষয়ে সচেতন নন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোন ও কম্পিউটার ব্যবহারেও চোখের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিন আমাদের চোখ, স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ডিজিটাল ডিভাইস চোখে যেসব বিপদ ঘটাতে পারে তা হলো:
* ফোন ও কম্পিউটারের অতি ব্যবহারে আই স্ট্রেইন (চোখের জ্বালাপোড়া) অথবা কম্পিউটার ভিশন সিন্ড্রোম হওয়া।
* চোখের পলক কম ফেলার কারণে ন্যাচারাল লুব্রিকেশন হারিয়ে ড্রাই আই ডিজিজ (চোখ শুকিয়ে যাওয়া) ও অস্বস্তি হওয়া।
* মায়োপিয়ার (দূরের জিনিস অস্পষ্ট দেখা) ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া অথবা ইতোমধ্যে বিদ্যমান মায়োপিয়া আরো বৃদ্ধি পাওয়া।
* ডিজিটাল ডিভাইসের নীল আলোতে উভয় চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অথবা ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া।
স্ক্রিন টাইম চোখে প্রভাব ফেলে যেভাবে
ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে চোখের ওপর প্রচুর চাপ পড়ে, বিশেষ করে চোখের চশমা বা কন্টাক্ট লেন্স ‘মিড ডিসট্যান্স ভিউ’ এর জন্য উপযুক্ত না হলে। এই চাপে কম্পিউটার ভিশন সিন্ড্রোম হতে পারে। যারা দীর্ঘসময় কম্পিউটার অথবা ফোন ব্যবহার করেন তাদের ৫০-৯০ শতাংশই সমস্যাটিতে আক্রান্ত হতে পারেন। কম্পিউটার ভিশন সিন্ড্রোমের প্রচলিত উপসর্গ হলো- চোখ ক্লান্ত হওয়া, চোখ শুষ্ক হওয়া, চোখে ব্যথা হওয়া ও মাথাব্যথা করা। এছাড়া ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিনের দিকে একটানা তাকালে ঘাড় ব্যথা ও পিঠের উপরিভাগে ব্যথা হতে পারে।
ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে চোখে সমস্যা হওয়ার অন্যতম কারণ হলো চোখের পলক ফেলার হার কমে যাওয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহারের সময় চোখের পলক ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। কেবল তা নয়, এসময় চোখের যেসব পলক পড়ে তা অসম্পূর্ণ হতে পারে। স্ক্রিনের ব্রাইটনেস ও ব্যবহারকারীরা কি করছেন তার ওপর ভিত্তি করে চোখের পলক ফেলার হার ব্যক্তিভেদে কম-বেশি হতে পারে। আপনি ডিজিটাল ডিভাইসে যত বেশি চিন্তাশীল কাজ করবেন চোখের পলক তত কম পড়বে। আমাদের চোখ নিজেকে আর্দ্র রাখতে টিয়ার লেয়ারকে রিফ্রেশ করে। কিন্তু একাজটা নির্ভর করে চোখের পলক পড়ার ওপর। চোখের পলক সংখ্যা যত কমে, আর্দ্রতাও তত কমে যায়। এভাবে একসময় ড্রাই আইজ ডিজিজ বা শুষ্ক চোখের উপসর্গ প্রকাশ পায়। চোখের শুষ্কতা থেকে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে।
ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে চোখে ক্ষতি হওয়ার আরেকটি কারণ হলো নীল আলো। যে আলো যত বেশি সাদা, সেই আলো তত বেশি ব্লু স্পেকট্রামের রঙ থেকে তৈরি। তাই আমরা যত বেশি সময় ফোন, কম্পিউটার ও অন্যান্য ডিভাইসের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকবো, আমাদের চোখ তত বেশি নীল আলোর সংস্পর্শে আসবে। চোখে নীল আলোর সংস্পর্শ যত বাড়বে, ক্ষতির পরিমাণ তত বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে। আমাদের চোখ নীল আলো পরিস্রাবণে তত কার্যকর নয় বলে প্রায় ১০০ শতাংশ নীল আলোই কর্নিয়ার মধ্য দিয়ে রেটিনাতে পৌঁছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, নীল আলো রেটিনাকে ড্যামেজ করে ও ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের ঝুঁকি বাড়ায়। বয়স্ক মানুষদের অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ম্যাকুলার ডিজেনারেশন।
সম্প্রতি চোখ বিষয়ক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার (দূরের জিনিস ঝাপসা দেখা) হার বেড়েছে। বেশিরভাগ অভিভাবকই জানিয়েছেন, এসব শিশুরা প্রতিদিন দীর্ঘসময় ফোন অথবা ট্যাব অথবা কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বর্তমানে চিকিৎসকেরা মায়োপিয়ার কেস এত বেশি দেখছেন যে এটাকে ভাইরাস মহামারির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। গবেষকরা ধারণা করছেন, যে হারে মায়োপিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে ২০৫০ সালে প্রায় ৫ বিলিয়ন লোকের সমস্যাটি থাকতে পারে। গবেষকরা অনেকটা নিশ্চিত যে ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার বাড়ার কারণে মায়োপিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যেসব শিশুর উচ্চ মায়োপিয়া রয়েছে তাদের চোখে ছানি, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, গ্লুকোমা ও রেটিনা ছিঁড়ে যাওয়ার বাড়তি ঝুঁকি রয়েছে।
ফোন ও কম্পিউটারের ক্ষতিকারক প্রভাব এড়াতে যা করবেন
এটা ডিজিটাল যুগ বলে ফোনের মতো প্রয়োজনীয় ডিভাইস সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের সময় সচেতন থাকলে চোখের সুরক্ষা সম্ভব হতে পারে। এখানে কিভাবে স্ক্রিন সংশ্লিষ্ট ডিভাইস থেকে চোখকে রক্ষা করা যায় তা সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া হলো।
* ২০-২০-২০ নীতি মেনে চলুন। এর মানে হলো- ফোন, ট্যাব অথবা কম্পিউটারের মতো ডিভাইস ব্যবহারের সময় প্রতি ২০ মিনিটে ২০ সেকেন্ড বিরতি নিয়ে ২০ ফুট দূরের কিছু দেখুন। বিরতি নিতে মনে করিয়ে দিতে পারে এমন একটি অ্যাপ ডাউনলোড করুন।
* কম্পিউটার বা ফোন স্ক্রিনের ব্রাইটনেস কমিয়ে ফেলুন। ফোনে আই প্রোটেকশন মোড অথবা নাইট মোড চালু করুন। নীল আলো ব্লক করতে পারে এমন লেন্স কোটিং বা চশমা ব্যবহার করুন।
* ল্যাপটপ বা ফোনে স্ক্রিন প্রোটেকটর লাগিয়ে নিন। স্ক্রিন প্রোটেক্টরও নীল আলো কমাতে পারে। রুমের আলো অনুসারে স্ক্রিনের ব্রাইটনেস অ্যাডজাস্ট করে নিলেও চোখ আরাম পাবে।
* স্ক্রিন টাইমেও স্বাভাবিক সময়ের মতো চোখের পলক ফেলুন। সাধারণত একজন মানুষে প্রতি ১০ সেকেন্ডে গড়ে একবার চোখের পলল ফেলেন। চোখের শুষ্কতা প্রতিরোধে চোখের পলক ফেলানোতে স্বাভাবিকতা ধরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
* শিশুর বয়স ১২ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত হাতে স্মার্টফোন অথবা ট্যাব তুলে দেয়া উচিত নয়। শিশুর চোখের পূর্ণাঙ্গ বিকাশসাধন হতে ১২ বছর সময় লাগে। তাই এসময়ের মধ্যে শিশুদেরকে স্মার্টফোনে আসক্ত করানোর মানে হলো তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়া।
* নতুন মডেলের মনিটর ব্যবহার করুন। এমন চশমা বা কন্টাক্ট লেন্স পরুন যা ‘মিড ডিসট্যান্স ভিউ’ এর জন্য তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ ডিজিটাল স্ক্রিনে বেশি সময় দিলে চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে প্রগ্রেসিভ লেন্স ব্যবহারের কথা বিবেচনা করতে পারেন। প্রগ্রেসিভ লেন্স ব্যবহার করলে সকল দূরত্বের স্ক্রিন বাধাবিপত্তি ছাড়াই স্পষ্টভাবে দেখা যায়।