স্টাফ রিপোর্টার:
বিশ্বময় মহামারি কভিড-১৯-এর ধাক্কা। আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়েছে ভয়াবহভাবে। দুই মাসেরও বেশি সময় অচল ছিল সব রকমের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। নিজেদের প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে এ সময় অনেক বড় আর সফল প্রতিষ্ঠানের প্রধানকেও হিমসিম অবস্থা হয়েছে। তারমধ্যেও করোনার এ কঠিন সময়ে দক্ষতার সঙ্গে নিজের প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসা সামাল দিয়েছেন বেশ কয়েকজন নারী নির্বাহী।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ১০টি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন নারী। এসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদেও নারী সদস্যদের সংখ্যা অনেক বেশি। করোনাকালে নারীপ্রধান এসব কোম্পানির ব্যবসায়িক দিকে চোখ ফেরানো যাক-
প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রকাশিত বাৎসরিক এবং প্রান্তিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে- ১০টির মধ্যে চারটি কোম্পানি এই সংকটের মধ্যেও আগের বছরের চেয়ে ভালো ব্যবসা করেছে। একটি কোম্পানির ব্যবসা সামান্য কমেছে। এছাড়া করোনার আঘাতে বাকী পাঁচটি কোম্পানির ব্যবসা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। তবে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর সিইওর প্রজ্ঞা আর দক্ষতার কারণে কোম্পানিগুলো গতি সঞ্চারে সমর্থ হয়েছে। সর্বোপরি বলা যায়, এসব নারী সিইওরা করোনার ধাক্কা ভালোই সামলে উঠেছেন।
করোনার মধ্যেও এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে ‘ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস’ এর ব্যবসা বেড়েছে ১১৪ কোটিরও বেশি। ২০১০ সাল থেকেই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে আছেন জেরিন করিম। এ বছরই তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস ব্যবসা করেছে ৭৬৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। করোনার মধ্যে এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যবসা করেছে ৫৩৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর আগের বছরের একই সময়ে ব্যবসা করেছিল ৪২১ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে ২০২০ সালের কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে জেরিন করিম বলেন, এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর, বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হই। কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সাপ্লাই চেইনে ধস, ঠিক সময়ে নগদ অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, অতি সাবধানী গ্রাহকদের চাহিদা মেটানোসহ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দুই ধরণের সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে আমাদের। লকডাউনের কারণে আর্থসামাজিক প্রভাব পড়েছে কোম্পানির ব্যবসায়িক পারফরম্যান্সেও। তবে এ সংকট কাটিয়ে উঠতে সহকর্মীদের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা পেয়েছি। পাশাপাশি সময়োপযোগী কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে কোম্পানির অবস্থা স্থিতিশীল রাখতে পেরেছি।
‘ফরচুন সুজ লিমিটেড’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোকসানা রহমানের নেতৃত্বে ১১৯ কোটি টাকারও বেশি ব্যবসা করেছে ফরচুন সুজ। যেখানে আগের বছর ব্যবসা হয়েছিল ১৫৪ কোটি টাকা। আর কারোনার এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে কোম্পানিটির ব্যবসা হয়েছে ৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যদিও আগের বছরের একই সময়ে ব্যবসা হয়েছিল ৮৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। করোনার কারণে যদিও কোম্পানিটির ব্যবসা কমেছে ৪২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। তারপরও চ্যালেঞ্জিং এসময়ে কোম্পানিটি ফোর্বসের এশিয়া অঞ্চলের সেরা ২০০ কোম্পানির তালিকায় উঠে এসেছে।
রোকসানা রহমান বলেন, করোনার সংক্রমণ শুরুর দিকেই আমরা সতর্ক হয়ে যাই। কারখানার মধ্যে সকল ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োগ শুরু করি। আমাদের নিজস্ব কাপড় ব্যবহার করে মাস্ক বানানো হয়। যা শ্রমিকসহ আমরা সবাই ব্যবহার করি। করোনার কারণে প্রায় তিন মাস আমরা কোনো শিপমেন্ট করতে পারিনি। তবে বিকল্প বাজার হিসেবে ভারতে রপ্তানি করতে পেরেছি। ফলে কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখতে পেরেছি। আমরা কোনো শ্রমিক ছাঁটাই করিনি। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ আমাদের বিশাল উপকারে এসেছে। সেই প্যাকেজ থেকে ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন পরিশোধ করেছি আমরা।
‘বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন রূপালী চৌধুরী। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এই ছয় মাসে ৬১৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ব্যবসা করেছে কোম্পানিটি। গত বছরের একই সময়ে ৭৫৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যবসা করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। করোনার কারণে ব্যবসা কমলেও নিত্যনতুন কৌশল গ্রহণ করে সংকট মোকাবেলা করে চলেছেন তিনি ।
করোনার ধাক্কা সামলানোর বিষয়ে রূপালী চৌধুরী জানান, করোনার অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য একেবারে নতুন। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির সময়ে আমাদের ব্যবসা একেবারেই বন্ধ ছিল। জুন থেকে আস্তে আস্তে ব্যবসা শুরু হয়। করোনার সংকট মোকাবেলায় ব্যবসা চালাতে আমাদের নতুন নতুন ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। এ সময়ে আমরা তালিকাভুক্ত প্রায় ২০ হাজার রঙ মিস্ত্রিকে আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি স্যানিটাইজার সামগ্রীও দিয়েছি। আমাদের যেসব স্থায়ী খরচ ছিল সেগুলো মেটানোর জন্য পরিকল্পনামাফিক ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় নিয়ন্ত্রণও করতে হয়েছে। তাই বলে আমরা কিন্তু কর্মীদের বেতন-ভাতা কমাইনি।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ‘আরামিট সিমেন্ট ও আরামিট লিমিটেড’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন রুকমিলা জামান। করোনার মধ্যেও এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে আরামিট সিমেন্ট ও আরামিট লিমিটেডের ব্যবসা খুব একটা খারাপ হয়নি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরামিট সিমেন্ট ১৯৩ কোটি ২১ লাখ টাকার ব্যবসা করেছে। তার আগের বছরে ব্যবসা হয়েছিল ১৮৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এ বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বরে ৭৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ব্যবসা করেছে। যদিও আগের বছর একই সময়ে ব্যবসা হয়েছিল ৯৮ কোটি ৭ লাখ টাকা। সে হিসাবে করোনার কারণে কোম্পানিটির ব্যবসা কমেছে ২৪ কোটি ১২ লাখ টাকা।
অপরদিকে আরামিট লিমিটেড ২০১৯-২০ বছরে ব্যবসা করেছে ৪৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। যেখানে তার আগের বছর ব্যবসা হয়েছিল ৪৪ কোটি টাকা। করোনার সময় এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাসে ২৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকার ব্যবসা করেছে। আগের বছরের একই সময়ে ব্যবসা করেছিল ২৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। করোনার সময়ে তার ব্যবসা না কমে সামান্য হলেও বেড়েছে।
দীর্ঘ ১০ বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পর ২০১৭ সাল থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে ‘মুন্নু সিরামিকস ও মুন্ন এগ্রো অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’ এর দায়িত্বে আছেন আফরোজা খান। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি মুন্নু সিরামিকস ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬০ কোটি ২৪ লাখ টাকার ব্যবসা করেছে। এর আগের বছর ব্যবসা করেছিল ১০৭ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর করোনার মধ্যে এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাসে কোম্পানিটির ব্যবসা হয়েছে ২২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ লাখ টাকা বেশি।
অপরদিকে মুন্নু এগ্রো অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবসা ২০১৯-২০ সালে হয়েছে ১০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। যেখানে আগের বছরে ব্যবসা হয়েছিল ১৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে কোম্পানিটির ব্যবসা হয়েছে ২ কোটি ৭ লাখ টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ব্যবসা হয়েছিল ৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। করোনার সময়ে ব্যবসা কমেছে ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
প্রকৌশল খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি ‘বিডি ল্যাম্পস’ এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত লতিফুর রহমানের মেয়ে সিমিন রহমান। এ বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন। এছাড়া তিনি ট্রান্সকম গ্রুপেরও সিইও হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিডি ল্যাম্পস ৯৪ কোটি ২ লাখ টাকার ব্যবসা করেছে। যেখানে আগের বছরে ব্যবসা করেছিল ১৫৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আর এ বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে কোম্পানিটির ব্যবসা হয়েছে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। যদিও আগের বছরের একই সময়ে ব্যবসা হয়েছিল ৬৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। সুতরাং করোনার প্রভাবে এ সময়ে কোম্পানিটির ব্যবসা কমেছে ২২ কোটি ৭ লাখ টাকা।
ট্রান্সকম গ্রুপের আরেকটি কোম্পানি ‘এসকেয়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড’ এর এমডি ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সিমিন রহমান। ওষুধ বিক্রির বাজার ২৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এক বছরে মোট বিক্রি বিবেচনায় অষ্টম অবস্থানে রয়েছে এসকেয়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। দেশে ওষুধ বিক্রির বাজারে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ৪.১৮ শতাংশ। গত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটির ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিল ৯৭৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। আর ওষুধ বিক্রি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৬৭ শতাংশ।
করোনার মধ্যেও চলতি বছরে এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি ৪৭৩ কোটি ১১ লাখ টাকার ব্যবসা করেছে ‘সামিট পাওয়ার’। এ সময়ে কোম্পানিটির ১ হাজার ৮৫৫ কোটি ৪১ লাখ টাকার ব্যবসা হয়েছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ব্যবসা হয়েছিল ১ হাজার ৩৮২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সামিট পাওয়ারের মূল প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদে ২০১৬ সাল থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন অন্যতম কর্ণধার আজিজ খানের মেয়ে আয়েশা আজিজ খান।
বিমা খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স’। প্রতিষ্ঠানটি এ বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাসে ১৮৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আয় করেছে। আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানির আয় হয়েছিল ২১৫ কোটি ২ লাখ টাকা। করোনার কারণে কোম্পানিটির প্রিমিয়াম আয় কমেছে ২৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা। কোম্পানির এমডি ও সিইওর দায়িত্বে রয়েছেন ফারজানা চৌধুরী। তিনি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা নাসির এ চৌধুরীর মেয়ে।
পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ওষুধ কোম্পানি ‘অ্যাম্বি ফার্মাসিউটিক্যালস’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন, নওরীন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। তিনি কোম্পানির চেয়ারম্যান আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের স্ত্রী। কোম্পানির সর্বশেষ বার্ষিক ও প্রান্তিক আর্থিক প্রতিবেদন এখনো প্রস্তুত না হওয়ার কারণে এর আর্থিক পারফরম্যান্সের তথ্য পাওয়া যায়নি।