মোঃ সাইফুল ইসলাম :পদ্মা-যমুনা ধলেশ্বরী নদী বেষ্টিত মানিকগঞ্জ-১ (ঘিওর- দৌলতপুর- শিবালয়) আসন গঠিত। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তবে কে কোন দলের প্রার্থী হচ্ছেন তা নিয়ে চলছে নানা ধরনের জল্পনা – কল্পনা। প্রথম থেকে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জের আসন ছিল ৪টি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আসন পুনর্বিন্যাস করায় মানিকগঞ্জের আসন সংখ্যা চার থেকে কমে তিনটি হয়। ফলে মানিকগঞ্জ-১ আসনে ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলার সঙ্গে শিবালয় উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একারনে এই আসনের প্রার্থীরা ভোটারদের মন যোগাতে হিমসিম খেতে হয় । ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন অধ্যক্ষ আবু মোঃ সায়েদুর রহমান। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হন বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ ও ১৯৮৮ সালে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির নেতা মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান। ১৯৯১ সালে পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ষষ্ঠ ও ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সপ্তম ও ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। বিএনপি সরকার দলীয় এবং বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন । ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে তাকে পরাজিত করে এই আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবিএম আনোয়ারুল হক। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক এবং এই আসনে সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত অধ্যক্ষ আবু মোঃ সায়েদুর রহমানের ছেলে এ.এম নাঈমুর রহমান দুর্জয়। তিনি জাসদ প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা আফজাল হোসেন খান জকিকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ নির্বাচনে মানিকগঞ্জের ৩ টি আসনের মধ্যে শুধু এই আসনেই নির্বাচন হয় ।
সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী বর্তমান সংসদ সদস্য ও জাতীয় ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক এ,এম নাঈমুর রহমান দুর্জয় । তিনি সরকারের উন্নয়ন মুলক কাজের ধারাবাহিকতায় তার নিজ আসনে ব্যাপক উন্নয়নমুলক কাজ করিয়েছেন । নদী ভাংগন রোধে শিবালয়ের জাফরগঞ্জ-আরিচা যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ, দৌলতপুরের বাঁচামারা, চরকাটারী ও ঘিওরের ধলেশ্বরী নদীর তীর সংরক্ষণ , দুটি কলেজ ও দুটি স্কুল সরকারী করন ,যুব কমপ্লেক্স ভবন নির্মান, অসংখ্য ব্রীজ কালর্ভাট ও তিনটি উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন , অনেক স্কুল ও কলেজের বহুতল ভবন নির্মান , দৃষ্টি ও শাররীক প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার জন্য নগদ অর্থ প্রদান, যমুনার র্দুগম চরাঞ্চলে সোলার প্ল্যান্ট প্রকল্প , পাটুরিয়ায় পদ্মার পারে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ ও পাটুরিয়া সড়কের পাশে হাইটেক র্পাক, এর সম্ভাব্য স্থানসহ নির্ধারন সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করায় এবারের নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী। তিনি নিয়মিত নির্বাচনী এলাকায় ঘুড়ে ঘুড়ে গনসংযোগ, উঠান বৈঠকে সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে নৌকার জন্য ভোট চাইছেন । দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত অধ্যক্ষ আবু মোঃ সায়েদুর রহমান এ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। মা নীনা রহমান জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি। আওয়ামীলীগ পরিবারের সন্তান হিসাবে এলাকায় রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। মনোনয়ন চাইবেন জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডঃ আব্দুস সালাম পিপি । প্রতিদিন তিনটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরকারের উন্নয়ন মুলোক কর্মকান্ড তুলে ধরছেন। স্বাধীনতার পর থেকে তিনি তিনটি উপজেলার আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের সকল প্রকার কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। ক্লিন ইমেজের প্রার্থী বলে তৃনমুলে নেতাকর্মীদের ধারনা। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ দলের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন ও পেশাগত কাজের ফাকে ফাকে নির্বাচনী এলাকায় উঠান বৈঠক, গন- সমাবেশ, চা চক্রের মাধ্যমে প্রচার প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন অনুষ্টানে। এলাকার লোকজনের কাছে ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে তার। পোষ্টার ,ফেস্টুন লাগিয়েছেন নির্বাচনী এলাকায়। নৌকা মার্কায় ভোট প্রার্থনা করে তিনি ব্যাপক গনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।। মনোনয়ন প্রত্যাশী এই আসনের আওয়ামীলীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম আনোয়ারুল হক নির্বাচনের প্রচারনায় মাঝে মাঝে এলাকায় যাওয়া আসা করছেন। অপর দিকে, আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আওয়ামীলীগ জেলা কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ (এস এম জাহিদ) ঘিওর, দৌলতপুর, শিবালয়ে এ তিনটি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক প্রচার প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন। পোস্টার ,ব্যানার ,বিলবোর্ড লাগিয়ে নির্বাচনী এলাকায় ছেয়ে ফেলেছেন। প্রতিদিন উঠান বৈঠক, সভা সমাবেশ ও সর্মথকদের নিয়ে যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন অনুষ্টানে। অনুদান দিচ্ছেন বিভিন্ন, মসজিদ, মন্দির, রাস্তা সহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে। এস এম জাহিদ এবার মনোনয়ন পাবেন বলে তার ঘনিষ্টজনদের আশা । তিন উপজেলায় তার রয়েছে ব্যাপক কর্মী বাহিনী। এ আসনে থেকে মনোনয়ন চাইবেন আওয়ামীলীগের জেলা কমিটির সদস্য ও মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৬নং ওর্য়াড কাউন্সিলর সুভাস সরকার । এছাড়া বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবি পরিষদের সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুব আইনজীবী পরিষদের সাবেক সভাপতি এ্যাডঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান কাদেরী এ আসনে প্রচার প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন। উঠান বৈঠক, সভা সমাবেশের মাধ্যমে তিনি নৌকা মার্কায় ভোট প্রার্থনা করে যাচ্ছেন। সরেজমিন পরিদর্শন এবং নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ -১ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে ভয়াবহ দ্বন্দ রয়েছে । যারযার মত করে প্রচারনা চালাচ্ছেন । কখনও কখনও কেউ কেউ অন্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে সমালোচনা মুলক কথা বলতে দ্বিধা করছে না । অভ্যন্তরীন দ্বন্দ, রেশারেশী, একাধিক গ্রুপিং থাকার কারনে বর্তমানে আওয়ামীলীগ চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পরেছে। জরুরী ভিত্তিত্বে গ্রুপিং নিরসন না করলে আওয়ামীলীগের নির্বাচন কঠিন হয়ে পরবে। তবে যিনি মনোনয়ন পাবেন তার হয়ে কাজ করার ঘোষনা কেউই দিচ্ছেন না। এতে করে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারন ভোটাররা দ্বিধা দ্বন্দে ভুগছেন ।
এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ৫ জন । এই আসনেও বিএনপির অভ্যন্তরীন কোন্দল রয়েছে দীর্ঘদিন থেকেই। প্রায়াত বিএনপির মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার আব্দুল হামিদ ডাবলু, এবং আরেক ছেলে জেলা বিএনপির কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ড. খন্দকার আকবর হোসেন বাবলুর সাথে জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতার দ্বন্দ রয়েছে । বিএনপির সাবেক মহাসচিব, প্রয়াত খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী, প্রয়াত হারুণার রশীদ খান মুন্নুরও দ্বন্দ ছিল দীর্ঘ সময় । এই দুই পরিবারের দ্বন্দ এখনও বিদ্যমান । এ আসনে খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের দুই ছেলে ডাবলু ও বাবলু দুইজনই মনোনয়ন প্রত্যাশী । তবে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী, প্রয়াত হারুণার রশীদ খান মুন্নুর মেয়ে মুন্নু গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা এই আসনে প্রার্থী হবেন বলে তার দলের নেতাকর্মী ও ঘনিষ্টজনরা জানিয়েছে। তিনি মানিকগঞ্জের তিনটি আসনেই প্রার্থীতা চাইবেন। এই আসনে প্রার্থী হলে বিএনপি তার হারানো আসন ফিরে পাবে বলে মনে করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বি এন পির সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য এস এ জিন্নাহ কবীর, তিনি বেশ আগে থেকেই এই আসনে নির্বাচন করার কথা জানান দিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় সভা- সমাবেশ, উঠান বৈঠক করে তিনি ধানের শীষ মার্কায় ভোট প্রার্থনা করেন। তবে একাধিক মামলা থাকার কারনে প্রকাশ্যে প্রচার প্রচারনা করতে পারছেননা । দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা বিএপির যুগ্ম সাধারন সম্পাদক তোজাম্মেল হক তোজাও এ আসনে প্রার্থী । তিনি এর আগেও এ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছেন । তবে এই আসনে ২০১৪ সনের নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ইনুর প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে পরাজিত হন মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন খান জকি । এবারের নির্বাচনে তাকে প্রচার প্রচারনায় তেমন দেখা যাচ্ছে না ।