মহিউদ্দিন খান:
বলতে দ্বিধা নেই, জন্মভূমি না-ঘুরে বিদেশে ঘুরে বেড়ানো মোটেই ঠিক হয়নি। সেই যে লোকে বলে- ‘পরের বাড়ির পিঠা গালে লাগে মিঠা’ বা ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া।’ পর্যটক হিসেবে আমার দেশ-বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয়েছিল প্রায় ৪০ বছর আগে ভারতের কলকাতা সফরের মধ্য দিয়ে। তারপর এশিয়ার সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, চীন, হংকং, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ থেকে শুরু করে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশেই যাওয়া হয়েছে। কিন্তু নিজ দেশের অনেক জেলায় যাওয়া হয়নি।
যাই হোক, পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যখন নিজেকে যুক্ত করলাম, কক্সবাজারে পাঁচ তারকা হোটেল ‘দি কক্স টুডে’সহ ঢাকায় গ্যালেসিয়া হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট এবং পরবর্তী সময়ে বান্দরবানে ডি’মোর বান্দরবান হোটেলসহ আরও বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম। এক সময় বাংলাদেশের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাসমূহ সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হলো, ব্যবসা এবং ভ্রমণ নেশা দুটোই আমাকে বাংলাদেশ ভ্রমণে আকৃষ্ট করতে থাকলো।
কক্সবাজার, বান্দরবান, সিলেট, চট্টগ্রাম- এসব তো দেখাই ছিল। যে জেলায় যাওয়া হয়নি সেসব স্থানে ভ্রমণ শুরু করলাম। বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা কুয়াকাটা, শ্রীমঙ্গল, রাঙামাটি জেলায় ভ্রমণ করলাম। আজ আমি আপনাদের শোনাব অসম্ভব সুন্দর, বিস্ময়কর একটি স্থানের ভ্রমণ কথা। ইদানিং বাংলাদেশের পর্যটকদের মধ্যে এক ধরনের ক্রেজ শুরু হয়েছে এই সুন্দর জায়গাটি নিয়ে। জায়গাটির নাম সাজেক ভ্যালি। রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত সাজেক একটি বিখ্যাত এবং অতি পুরাতন (১৮৮০ সাল থেকে) পর্যটন স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭২০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এবং এর কংলাক পাহাড়টি ১৮০০ ফুট উপরে অবস্থিত।
ব্যবসায়িক ও পরিদর্শন উপলক্ষ্য করে ঢাকা থেকে সাজেকের উদ্দেশে রওনা হই মাইক্রোবাসে করে। সারাদিন দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যখন খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছাই তখন সন্ধ্যা নেমেছে। জানা গেল, সাজেক যাবার উপায় অতটা সহজ নয়। খাগড়াছড়ি শহরে রাত যাপন করে পরদিন সকালে বিজিবির তত্ত্বাবধানে বিশেষ গাড়িতে করে সাজেক যেতে হবে। আমরা খাগড়াছড়ি শহরে একটি হোটেলে রাত যাপনের ব্যবস্থা করলাম।
সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টা থেকে যাত্রা শুরু হয়, সকাল সাড়ে ১০টার পর আর গাড়ি যায় না। আমরা একটি চাঁদের গাড়ি (বিশেষ ধরনের ফোর হুইল গাড়ি) রির্জাভ করে সকাল সাড়ে ৯টায় রওনা হলাম। সামনে পেছনে বিজিবির গাড়ি, মাঝখানে এক সারিতে প্রায় ৩০-৪০টি গাড়ির বহর আমাদেরকে স্কট করে পাহাড়ি রাস্তায় রওনা হলো। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, চারদিকে সবুজ গাছগাছালি, মাঝে মাঝে চোখে পড়ে আদিবাসীদের জীবনযাপন। আদিবাসীদের কোনোরকমভাবে বেঁচে থাকার বাঁশের মাচানের ওপর তৈরি ছনের ঘরবাড়ি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস, জুমচাষ, গাছ কেটে জ্বালানি সংগ্রহ করে মাথায় বা রোদে ঝলসানো পিঠে বয়ে নিয়ে যাবার করুণ দৃশ্য। আর একটি সুন্দর দৃশ্য বেশ আনন্দ দিয়েছে, তা হলো আদিবাসী ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হাত নেড়ে নেড়ে আমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে আর যেন বলছে- ‘আসুন, দেখে যান কী রকমভাবে বেঁচে আছি আমরা’!
গাড়ি যে ক্রমাগত ওপরের দিকে উঠছে তা বোঝা যায়। খোলা গাড়িতে বসে গোত্তা খেতে খেতে আমরা উঠে যাচ্ছি আকাশের দিকে, মেঘের দিকে। বহুদূরে নজরে আসে ভারতের মিজোরাম সীমান্তের বড় বড় পাহাড় আর মেঘের আনাগোনা। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। আমরা দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সাজেকে। সাজেক মানে একটি সমতল রাস্তা, রাস্তার দুদিকের ঢালে কটেজের মতো ছোট ছোট হোটেল। এগুলোকে হোটেল বলা বোধ হয় ঠিক হবে না, অন্যরকম আবাসন ব্যবস্থা। একেকটি ১০-১২ ফুট রুমের বাঁশের মাচানের ওপর ঘুমানোর জায়গা। মাঝে মাঝে খাবার হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পাহাড়ি মেয়েদের চা দোকান।
দু’একটা একতলা দোতলা বিল্ডিং চোখে পড়েছে, তবে তা বিশেষ বাসিন্দাদের বসতবাড়ি। একেবারে রাস্তায় উঠেই একটি দোতলা বাড়ি। জানা গেলো, এটি এলাকার সর্দার বা হেডম্যানের বাড়ি। পুরো সাজেকের এই রাস্তাটিই সব। দুদিকে গভীর খাদ এবং দূরে পাহাড়। সবুজ ও মেঘের মাখামাখি। রাস্তাটি এই মাথা থেকে ওই মাথা খুব বেশি হলে এক দেড় মাইলের বেশি না। ওই দিকের শেষ মাথায় বিজিবির কিছু ভবন, রেস্টহাউস আছে, আর আছে একটি বিশাল হেলিপ্যাড। পাহাড়ের ওপর পরিচ্ছন্ন হেলিপ্যাডটি চমৎকার।
সাজেকের এই পাড়াটির নাম রুইলুই পাড়া। আমরা বিকালে এই রুইলুই পাড়া থেকেই ট্রেকিং করে কংলাক পাহাড়ে উঠলাম। পাহাড়ে ট্রেকিং করার জন্য হাতে একটি বাঁশের লাঠি ধরিয়ে দেয়া হয়, এটিকে অবলম্বন করেই আস্তে আস্তে পাহাড়ে উঠতে হয়। রোমাঞ্চকর তো বটেই। কংলাক হচ্ছে সাজেকের সর্বোচ্চ পাহাড়, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট ওপরে। পাহাড়ে উঠার কষ্ট যেমন আছে, তেমনি মজাও আছে, তা না হলে মানুষ কষ্ট করে ওঠে কেন? এ যেন উপরে ওঠার চেষ্টা, কিছু বিজয় করার চেষ্টা। কষ্ট হলো- শরীরের সব শক্তি যেন শেষ হয়ে গেল। ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত, ওপড়ে উঠে বিজয়ের আনন্দ সব ক্লান্তি দূর করে দিলেও ছোট্ট দোকান থেকে ঠান্ডা ড্রিংকস কিনে খেয়ে প্রাণ জুড়ালাম। কংলাকে উঠে আদিবাসীদের কিছু পরিবার পাওয়া যায়, তাদের জীবনযাপনের কিছু চিত্রও পাওয়া যায়।
কংলাক পাহাড় থেকে ভারতের মিজোরাম সীমান্তের বড় বড় পাহাড়, গভীর সবুজারণ্য, সাদা মেঘপুঞ্জ-এ এক অসাধারণ দৃশ্য। সাজেকের এই কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয় দেখা যায়। সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে যেমন অতলান্ত নীল জলরাশি দেখে আনন্দ পাওয়া যায়, এখানে দাঁড়িয়ে তেমনি অসীম সবুজের অরণ্য অন্য রকম এক অনুভূতির জন্ম দেয়। নীল আকাশের সাথে সবুজের মিশে যাওয়া, তার মাঝে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি মনকে কোথায় যেন উড়িয়ে নিয়ে যায়। কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পুরো রাঙামাটি জেলা, ভারতের মিজোরাম সীমান্ত সবই মোটামুটি দেখা যায়।
সন্ধ্যার আগেই আমরা পাহাড় থেকে নেমে এলাম, নামতে তেমন কষ্ট হয় না, তবে সাবধানে নামতে হয় যাতে পা হড়কে পড়ে না যায়। সন্ধ্যা নামছে, দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছে, চারদিকে অন্ধকার এসে দৃষ্টিকে আটকে দিচ্ছে। আবছা অন্ধকারে আর এক অপরূপ দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। আমরা হেলিপ্যাডের খোলা জায়গায় একটু ঘোরাঘুরি করলাম। ছবি তুললাম, ছবি তো সারা দিনই তুলেছি, সব দৃশ্য মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধরে রাখার চেষ্টার অভাব ছিল না কারোরই।
আমরা ফিরে এলাম আমাদের কটেজের কাছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আদিবাসী সুন্দরী মেয়েটার হাতের চা খেলাম। আকর্ষণীয় বিষয় হলো- চায়ের কাপটি বাঁশের চোঙ দিয়ে বানানো। চায়ের এতো স্বাদ আগে পেয়েছি বলে মনে পড়লো না। আর্কিটেক্ট হাসান ভাই চা খেয়ে মুগ্ধ হয়ে আদিবাসী মেয়েটিকে তার চায়ের দোকানের সহজ কিন্তু সুন্দর একটা ডিজাইন সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বানিয়ে দিলো। আমরা রাতের আলো আঁধারিতে সাজেকের অপূর্ব সুন্দর একমাত্র রাস্তাটিতে হাঁটলাম। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। এ যেন বাংলাদেশ নয় দার্জিলিংয়ের কোনো পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটছি। রাস্তার পাশের কোনো কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসছে আদিবাসীদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গাওয়া তাদের নিজস্ব রীতির গান। তাদের বিনোদন, তাদের বেঁচে থাকার আনন্দ। বেড়াতে যাওয়া তরুণ পর্যটকদের আনন্দ, উল্লাস, কোলাহল তো আছেই।
আমাদের রাতের খাবারের অর্ডার দিলাম মোটামুটি পরিচ্ছন্ন একটি বড় রেস্টুরেন্টে। আমাদের মেন্যু ছিল বাঁশের চোঙের ভেতরে রান্না করা মোরগ-পোলাও। সাথে সালাদ এবং আরও কিছু ছিল কিন্তু বাঁশের চোঙে রান্না করা মোরগ পোলাও এতো স্বাদের হয়েছিল এবং এতো মজা করে খেয়েছি যে, অন্য সব খাবারের কথা ভুলেই গেছি! রাতে খাওয়ার পর একটু হাঁটাহাঁটি, চা-সিগারেট খেয়ে কটেজে ফিরলাম এবং ঘুমানোর আয়োজন। পাঁচ তারকা হোটেলে রাত যাপনের অভিজ্ঞতা আর বাঁশের মাচার ওপর টং ঘরে থাকার অভিজ্ঞতা সবটাই জীবনের অংশ এবং পরমানন্দের।
সাজেক বাংলাদেশের অন্তর্গত অসাধারণ একটি পর্যটন স্থান। এটিকে রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন করার দায়িত্ব সরকারের। আমরা সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ করবো- এই অপূর্ব সুন্দর ভ্রমণ গন্তব্যটিকে পর্যটকদের আবাসন ব্যবস্থাসহ অনান্য সুযোগ সুবিধার মানোন্নয়ন করার জন্য। দুর্গম পাহাড়ে পানির অপ্রতুলতা নিরসন, রাস্তার উন্নয়ন, সর্বোপরি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে বিশেষ নজর দেয়া জরুরি।
পরদিন সকালে উঠে নরম হাওয়ায় পরিচ্ছন্ন রাস্তাটি দিয়ে হাঁটছিলাম। রাস্তার পাশে পসরা সাজিয়ে বসেছে আদিবাসী মেয়েরা। পাহাড়ে ফলানো তাদের নানা রকম সবজি, পাহাড়ি কলা এবং জুমচাষের বিন্নি ধানের চাল; যাকে আমরা বলি স্টিকি রাইস, আর কত কী। স্টিকি রাইস আর পাহাড়ি কলা কিনে ফিরে এলাম কটেজে। এরপর ফেরার আয়োজন। নাস্তা করে রেডি হতে হবে। কারণ, যথারীতি সকাল সাড়ে ৯টা থেকেই ফিরতি যাত্রা শুরু হবে।
যাত্রা শুরু হলো আমাদের গাড়ি বহরের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায়। এবারও আদিবাসী শিশুরা আমাদেরকে আগের মতোই হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানাচ্ছিল, যেন তারা বলছিল- ‘আবার এসো’। সবুজ পাহাড়ি ঢাল, আদিবাসীদের বাড়ির উঠানে পাহাড়ি মোরগের স্বাধীন বিচরণ, লোমশ সুদর্শন কুকুরের ঘেউ ঘেউ, পাখির ওড়াউড়ি সব পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। সাজেকের অপরূপ সৌন্দর্যের স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করে আমরা ফিরে এলাম খাগড়াছড়ি। সেখানে অপেক্ষমান আমাদের গাড়িতে রওনা হলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশে।