এস এম আকরাম হোসেন :
মাথায় ১৮টি সেলাই নিয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ৭০ বছরের বিধবা সুরুপজান। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী শহর আলী ও তার পরিবারের সদস্যরা চাপাতি দিয়ে তাঁর মাথায় কুপিয়ে এবং শরীরে বিভিন্ন অংশে কাঠের বাটাম, লোহার পাইপ ও রড দিয়ে পিটিয়ে তাঁকে আহত করে। শুক্রবার (১৫ জুলাই) সন্ধ্যায় মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার দক্ষিণ মকিমপুর গ্রামে হামলার ঘটনা ঘটে।
এই ঘটনায় হামলাকারী শহর আলীসহ ৭জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৪/৫জনকে অজ্ঞাত আসামী করে মানিকগঞ্জ সদর থানায় মামলা দায়ের করেছেন আহত সুরুপজানের ভাতিজা মোঃ শরিফুল ইসলাম শরিফ।
আহত সুরুপজান মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার রাজিবপুর গ্রামের মৃত আশরাফ আলী স্ত্রী।
মামলার বাদী মোঃ শরিফুল ইসলাম শরিফ বলেন, ‘মামলার আসামীরা আমার আত্মীয়-স্বজন। জমি-জমা নিয়ে তাদের সাথে আমাদের পূর্ব শত্রুতা রয়েছে। সম্প্রতি শহর আলী মেয়ে আসমা বেগম আমার সৎ মা রাহেলা বেগম, বাবা, ভাইসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে। একারণে তারা সকলেই বাড়ি ছেড়ে পলাতক রয়েছে। আমার সৎ ভাই, সৌদী প্রবাসী মো: ফরিদের স্ত্রী নিলুফা বেগম ৪০ দিনের শিশু সন্তান নিয়ে বাড়িতে একা থাকার কারণে আমার ফুফু সুরুপজান তাদের দেখাশোনা করতে ওই বাড়িতে আসেন। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শহর আলী, তার ছেলে আনোয়ার, আওলাদ, মনির, মেয়ে আছমা, ছেলে আনোয়ারের স্ত্রী বিলকিছ ও মনিরের স্ত্রী রোকসানাসহ ৪/৫জন অজ্ঞাত ব্যক্তি ওই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে আমার সৎ মা রাহেলা ও সৎ ভাইয়ের স্ত্রী সিলুফা বেগমকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। আমার ফুফু সুরুপজান তাদের গালিগালাজ করতে নিষেধ করলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে আমার ফুফুর মাথায় কোপাতে থাকে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে কাঠের বাটাম, লোহার পাইপ ও রড দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। তাদের হামলা স্বীকার হন আমার সৎ ভাইয়ের স্ত্রী, ৪০ দিনের শিশুর মা নিলুফা বেগমও। তারা ঘরের ভেতরে থাকা আসবাবপত্র ভাংচুর করেছে, যার মূল্য ৬০ হাজার টাকা। এছাড়া, তারা আমার ফুফুর গলা থেকে ছয় আনা ওজনের একটি স্বর্ণের চেইনও নিয়ে যায়। পরে খব পেয়ে আমরা মৃতপ্রায় রক্তাক্ত অবস্থায় আমার ফুফু ও সৎ ভাইয়ের স্ত্রী নিলুফা বেগমকে তাঁর ৪০ দিনের শিশু সন্তানসহ উদ্ধার করে মানিকগঞ্জ ২৫০-শয্যাবিশষ্ট জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যাই। কর্তব্যরত চিকিৎসক ও তাঁর সহযোগিরা আমার ফুফুর মাথার ৫টি ক্ষতস্থানে ১৮টি সেলাই করে সার্জারী ওয়ার্ডে ভর্তি করেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে জরুরী ভিত্তিতে তাঁর শরীরে দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। ঘটনার তিন দিনেও আমার ফুফু অচেতন অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রয়েছে। তিনি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।’
আজ (সোমবার) বিকালে আহত এই বিধবা নারীকে হাসপাতালের ছয় তলায়, সার্জারী ওয়ার্ডের ২৫ নং বেডে অচেতন অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখা গেলো। তাঁর সাথে থাকা দুই নারী বলেন, মাঝে মাঝে নড়াচড়া দেয়, কথা বলতে চায়। কিন্তু কথা বলতে পারছে না।
হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্সিং কর্মকর্তারা রোগীর ভর্তি ফাইল দেখে বলেন, শুক্রবার (১৫ জুলাই) রাত সাড়ে আটটার দিকে জরুরী বিভাগ থেকে রোগীকে সার্জারী ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেছিলেন। কিন্তু রোগীর স্বজনরা বন্ডসই দিয়ে তাঁকে এখানে রেখেছেন।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. কাজী একেএম রাসেল বলেন, ‘রোগীকে দেওয়া হচ্ছে। অন্য কিছু খাওয়ার পর্যায়ে তিনি নেই। সিটি স্ক্যান করতে বলা হয়েছে। যাবতীয় পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর তাঁর শরীরের প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে। তবে, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছি। তাঁর শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা উন্নত হয়েছে। আমরা আশাবাদী তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন ‘
মানিকগঞ্জ সদর থানার অফিসার-ইন-চার্জ আব্দুর রউফ সরকার বলেন, ‘ঘটনার রখবর পাওয়ার সাথে সাথে আহত রোগী দেখতে হাসপাতালে পুলিশ সদস্য পাঠাই। এবং পরবর্তীতে লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা নেওয়া হয়েছে। মামলা নং ৩৬/১৬/০৭/২০২৩। অভিযুক্ত প্রধান আসামীকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তিনি জেল হাজতে আছেন। অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এব্যাপারে নির্দেশণা দেওয়া হয়েছে।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সজিব আহমেদ জানান,’আমি তদন্তকাজ শুরু করেছি। আশাকরি দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্তপূর্বক আদালতে চার্জশীট বা তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে পারবো এবং পলাতক আসামীদের গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করতে পারবো।’
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সকলেই ঘটনার পর থেকে পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার দক্ষিণ মকিমপুর গ্রামের এই শহর আলী একজন মামলাবাজ ব্যক্তি। তিনি নিজে এবং তার লোকজনদের দিয়ে গ্রামের সাধারণ নিরীহ লোকজনের বিরুদ্ধে আদালতে ও থানায় মামলা দিয়ে হয়রানী করে থাকেন। এর থেকে তিনি অর্থ উপার্জন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি এবং তার ছেলে আনোয়ার, মনোয়ার এর আগে বহু মানুষকে মারধর করে আহত করেছে। তার ছেলে আওলাদ চুরি করতে যেয়ে বহুবার গনপিটুনী খেয়েছে। তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের এই লাগামহীন অপকর্মের সাথে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের কিছু লোকজন জড়িত থাকার কারণে গ্রামের নিরীহ লোকজন তাঁর অপকর্মের প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। তবে, সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে গ্রামবাসী প্রশাসন বরাবর একটি পিটিশন দিয়েছে। সম্প্রতি মানিকগঞ্জ সদর থানায় সৌদী প্রবাসী মোঃ ফরিদ, তাঁর মা রাহেলা বেগমসহ নিকটতম আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ শহর আলী তার মেয়ে আসমাকে দিয়ে করিয়েছেন তাও ভিত্তিহীন বলে জানা গেছে। মামলার বিবরণে উল্লেখিত কোন ঘটনাই সেখানে ঘটে নাই বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসী এবং ভূক্তভোগীর স্বজনের। তার পরিবারের সদস্য