1. hasanchy52@gmail.com : admin :
  2. amarnews16@gmail.com : Akram Hossain : Akram Hossain
শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৬ পূর্বাহ্ন

জীবনের শত্রু ভাইরাস

  • প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার, ৭ এপ্রিল, ২০২০
  • ৭৭৪ বার দেখা হয়েছে
সুরুয খান:
সাম্প্রতিককালে ‘ভাইরাস’ শব্দটির সঙ্গে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরীব সবাই পরিচিত হয়ে গেছি। এর কারণ ‘কোভিট-১৯’ রোগ যা নভেল করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট। প্রথমে রোগটিকে ২০১৯-এনকভ নামে আখ্যায়িত করা হলেও পরে তা কোভিট-১৯ নামে চূড়ান্ত করা হয়। বিশ্বের দেশে দেশে এখন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ।  বাংলাদেশেও থাবা বসিয়েছে করোনা। প্রায় প্রতিদিনই আক্রান্তের তালিকা বড় হচ্ছে। তাই সর্বত্রই এখন এই ভাইরাসের আলোচনা। ভাইরাসের কথা আমরা অবশ্য প্রায়ই বলি। যেমন ‘ভাইরাস জ্বর’, ‘ভাইরাস ইনফেকশন’ ইত্যাদি। কিন্তু এই করোনাভাইরাসটি সারা বিশশ্ব এতো দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে যে তা এখন সারা বিশশ্বরই মানুষের সমস্যা। গত ১১ মার্চ করোনাভাইরাস সঙ্কটকে বৈশশ্বক মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( ডব্লিওএইচও )।
প্রশ্ন আসেই, এই ভাইরাস জিনিসটা কী? জীব-বিজ্ঞানীরা মনে করেন, নিউক্লিক এসিডসহ নানারকম জৈব-পদার্থ ও প্রোটিন মিলে প্রাগৈতিহাসিককালে ভাইরাসের সৃষ্টি। ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করতে পারে। তবে এর জন্য তাকে অন্য জীবন্ত প্রাণী বা উদ্ভিদ-কোষের সংস্পর্ষে আসতে হয়।
‘ভাইরাস’ ল্যাটিন শব্দ। এর অর্থ হলো বিশ। প্রাণী বা উদ্ভিদ-দেহে ভাইরাসের প্রতিক্রিয়া বিষের মতোই। ভাইরাস একরকম জৈব বিষ বা টক্সিন উৎপন্ন করে। ভাইরাস আকারে এতোই ছোট যে খালি চোখে তো দূরের কথা, সাধারণ অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও তাদের দেখা যায় না। সাধারণত এদের আকার ১০ এনএম থেকে ৩০০ এনএম পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিছু ভাইরাস এর চেয়ে বড় হতে পারে। ভাইরাস দেখার জন্য দরকার হয় শক্তিশালী ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের। ১৯৩৩ সালে জার্মান বিজ্ঞানী আর্নস্ট রুসকা এই যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে যে-কোনো জিনিসকে প্রায় দশ লক্ষ গুণ বড়ো দেখা যায়। ভাইরাস সাধারণত গোলাকার, দন্ডকার, বর্তুলাকার, সূত্রাকার, পাউরুটি আকার, বহুভুজাক্রিতি, ব্যাঙ্গাচি আকার প্রভৃতি হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানী চার্লস ক্লসিয়াস ১৫৭৮ সালে কচি তামাক পাতার ‘মোজেইক’ রোগের কারণ আবিষ্কার করতে গিয়ে দেখেন, একরকম ভাইরাসই এর জন্য দায়ী। অবশ্য তিনি একে ঠিক ভাইরাস বলে চিনতে পারেন নি। ১৮৯২ সালে রুস বিজ্ঞানী ইভানোভস্কি আবিষ্কার করেন যে, মোজেইক-আক্রান্ত তামাক পাতার রস দিয়ে অন্য সুস্থ গাছে রোগ সংক্রমণ করা যায়। এর ছ’ বছর পর ওলন্দাজ বিজ্ঞানী বাইজারিংক ওই একই তামাক পাতার ‘মোজেইক’ রোগের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘ভাইরাস’ শব্দটি ব্যবহার করেন।
উদ্ভিদ, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া, সায়ানোব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রভৃতি জীবদেহের সজীব কোষে ভাইরাস সক্রিয় অবস্থায় অবস্থান করতে পারে। আবার নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বাতাস, মাটি, পানি ইত্যাদি প্রায় সকল জড় মাধ্যমে ভাইরাস অবস্থান করে। কাজেই বলা যায়, জীব ও জড় উভয় পরিবেশেই ভাইরাসের আবাস।
ভাইরাস মানুষ, পশু-পাখি ও উদ্ভিদের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী। ভাইরাসজনিত কারণে মানুষের মধ্যে বসন্ত, জলাতঙ্ক, জন্ডিস, ডেঙ্গু, হাম-রুবিওয়ালা, ভাইরাল ডায়ারিয়া, সাধারণ ঠান্ডা, এইডস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সার্স, ভাইরাল হেপাটাইটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি এবং সাম্প্রতিকালে কোভিট-১৯ রোগ বিস্তার করছে। পশু-পাখির বার্ড-ফ্লু, ক্যানাইন ডিস্টেম্পার, ফুট এন্ড মাউথ ডিসিজ এবং উদ্ভিদের টোব্যাকো মোজেইক ভাইরাস বা টিএমভি রোগ দেখা দেয়।
নভেল করোনাভাইরাস করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতি। করোনাভাইরাস ১৯৬০ এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে ভাইরাসটির বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায়। ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইসসিওভি এনএল-৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ-১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে ‘নভেল করোনাভাইরাস’ যা বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়।
নভেল করোনাভাইরাস এক ধরনের বড় আকৃতির ভাইরাস। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারির জন্ম দিয়েছে এই ভাইরাসটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নভেল করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট রোগের নাম দিয়েছে কোভিট-১৯। এই রোগের লক্ষণ হলো সর্দি, কাশি, বুক ও গলা ব্যাথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও অবসন্নতা। অনেকের ক্ষেত্রে ডায়রিয়াও দেখা দেয়। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা নতুন দ’ুটি উপসর্গেরও দেখা পাচ্ছেন। তা হলো স্বাদহীনতা ও গন্ধহীনতা। তবে এ উপসর্গ দু’টি বেশি দেখা যাচ্ছে তরুণ আক্রান্তদের মধ্যে।
সার্স বা মার্সের মতো করোনাভাইরাস নিয়ে আগে যেসব গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, কঠিন কোন জায়গার ওপর ধাতুর তৈরি, কাচ বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি কোনো সারফেসের ওপর করোনাভাইরাসের জীবাণু বেঁচে থাকে প্রায় দুই ঘন্টা থেকে সর্বোচ্চ নয় দিন।
সব রোগের ভাইরাস এক নয়। ভাইরাসজনিত অনেক রোগেরই প্রতিষেধক টিকা বা ভ্যাকসিন বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছন। বসন্ত জাতীয় ভাইরাস ঘটিত রোগের প্রতিরোধক হিসেবে ভ্যাক্সিন প্রথম আবিষ্কার হয়। গুটি বসন্তই প্রথম মহামারি, একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যার ইতি ঘটেছিল। গুটি বসন্ত মহামারি হিসেবে দেখা দেওয়ার প্রায় শতাব্দীকাল পর এডওয়ার্ড জেনার নামের একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক গুটি বসন্তের টিকা তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেন। তাঁর দেখানো পথ ধরেই গুটি বসন্তের কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা খুব দীর্ঘ ছিল। অবশেষে ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীকে গুটি বসন্ত মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করে। পাস্তুর আবিষ্কার করেন জলাতঙ্ক ও অ্যানথ্রক্সের টিকা। পোলিও-র টিকা আবিষ্কার করেছেন ডা. মক ও ডা. সাবিন নামে দু’জন চিকিৎসা বিজ্ঞানী। গত বছর বিশ^ব্যাপী টিকা বিক্রি হয়েছিল পাঁচ হাজার চারশো কোটি ডলার যা ২০১৪ সালের দ্বিগুণ। আর এ বৃদ্ধির মূল কারণ হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা, সোয়াইন ফ্লু, হেপাটাইটিস ও ইবোলার মতো রোগগুলো। এখন কোভিট-১৯ এর টিকার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু টিকার ক্ষেত্রে বিক্রির অনুমতি পাওয়ার আগে অনেক সময় লম্বা সময় ধরে হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।
২০০২ ও ২০০৩ সালে সার্সের সময় কোনো টিকাই আনা যায় নি। সার্সের জন্য এখনো কোনো টিকা নেই। ইবোলার ক্ষেত্রে প্রথম টিকা বাজারে এসেছিল ২০১৫ সালে। পশ্চিম আফ্রিকায় সেটি সফল হয়েছিল। কিন্তু মার্কের তৈরি সে ভ্যাকসিন যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর পর্যন্ত অনুমোদন দেয় নি। ২০১৯ সালে কঙ্গোতে ইবোলার আরেকটি ভ্যাকসিন এনেছে জনসন এ্যান্ড জনসন। ২০০৯-১০ সালে সোয়াইন ফ্লু’র সময় প্রায় ষাট লাখ মানুষকে গ্লাক্সোস্মিথক্লেইনের পানডেমরিক্স ভ্যাকসিন দেওয়া হলেও পরে কিন্তু সমস্যার জন্য বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোভিট-১৯ রোগের টিকা কিংবা এর চিকিৎসার কার্যকর কোনো ওষুধ বের হয় নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিট-১৯ এর ভ্যাকসিন আসতে এক বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে। ওদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশা করছে দেড় বছরের মধ্যে এ ভ্যাকসিন বাজারে আসবে। যেমনটি গবেষক অ্যান্থনি ফাউসি বলেছেন, সবাইকে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন হবে করোনাভইরাসের ভ্যাকসিনের। অনেক কোম্পানি ও সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করা হচ্ছে। তবে এসব ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য সময় লাগবে।
প্রসংগত, চীনে ২০০২ সালে দেখা দেওয়া সার্স করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছিল ২০ মাস। তাও সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে। জিকা ভাইরাসের সংক্রমণের শুরুটা হয়েছিল ২০১৫ সালে। আর এর প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে সময় লেগেছিল ছয় মাস।
ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৩ বছর বয়সী এক নারীর দেহে পরীক্ষামূলক ভাবে নভেল করোনার প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয়েছে। জাপানেও সফলতার কথা বলা হচ্ছে। তবে এগুলো আসলে প্রতিষেধক পরীক্ষার প্রথম ধাপ। এরপর আরও কয়েক ধাপে সফল হলে তা সবার ব্যবহারের জন্য নিরাপদ বলে স্বকিৃতি পাবে।
অনেক দেশের অনেক বিজ্ঞানী মিলে আজ নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে তাঁরা এই ভাইরাসজনিত কোভিট-১৯ রোগের ওষুধ আবিষ্কার করতে পারবেন।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব পদার্থবিদ ও নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী মাইকেল লেভিট বলেছেন, নতুন করোনাভাইরাস শিগগিরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমরা বিশ্ববাসী সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম।

শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরও খবর
© All rights reserved © 2014 Amar News
Site Customized By Hasan Chowdhury