স্টাফ রিপোর্টার:
কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের বোন পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। আজ বুধবার দুপুরেরদিকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (নম্বর ৩-টেকনাফ) মামলাটি করা হয়। এই হত্যা মামলাটি দায়ের করেন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস।
মামলায় টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস এবং বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকতসহ নয়জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলার তদন্ত করার জন্য র্যাবকে দায়িত্ব দিয়েছে আদালত।
কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর পুলিশ তল্লাশিচৌকিতে গত ৩১ জুলাই রাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান (৩৬)। এ ঘটনার বিচার চেয়ে আজ বেলা সাড়ে ১১টারদিকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করেন নিহত ব্যক্তির বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। আদালতের বিচারক তামান্না ফারাহ মামলাটি গ্রহণ করেন। তিনি এজাহারটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে সাত দিনের মধ্যে আদালতকে অভিহিত করতে টেকনাফ থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি মামলাটি তদন্ত করে আদালতকে জানানোর জন্য র্যাব-১৫ কক্সবাজার ক্যাম্পের অধিনায়ককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন বাদীপক্ষের আইনজীবী ও কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা। তিনি দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, আজকেই (বুধবার) মামলার এজাহার টেকনাফ থানায় পৌঁছানো হবে।
এ সময় আইনজীবীর পাশে ছিলেন মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়াসহ নিহতের পরিবারের অন্য সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ঢাকা থেকে আসা হাইকোর্টের আইনজীবী আনোয়ারুল কবিরও। অবশ্য, তাঁদের কেউই সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১, ৩৪ ধারায় দায়ের করা এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার পূর্ব হুলাইন গ্রামে। দুই নম্বর আসামি হয়েছেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। মামলার অপর সাত আসামি হলেন থানার এসআই দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা।
মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে নিহত সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে। তাঁর বাড়ি বরগুনার পূর্ব শফিপুর গ্রামে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ৩১ জুলাই বিকেলে মেজর (অব) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে নিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্ট থেকে তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণের জন্য টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়ে যান। এ সময় সিনহার পরনে ছিল কমব্যাট গেঞ্জি, কমব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট। তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণ করার উদ্দেশ্যেই এই পোশাক তিনি পরেছিলেন।
এজাহারের ভাষ্যমতে, রাত আটটা পর্যন্ত পাহাড়ে ছিলেন সিনহা ও সিফাত। তাঁরা পাহাড়ে দিনের ও সন্ধ্যাকালের দৃশ্য ধারণ করেন। রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে নিজস্ব প্রাইভেটকারে শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পৌঁছালে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ আসামিরা গাড়িটির গতিরোধ করেন। এ সময় সিনহা নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। তখন আসামিরা সিফাতকে গাড়ির সামনের বাঁ দিকের দরজা খুলে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যান। এ সময় সিফাত দুই হাত ওপরে তুলে নিজের এবং গাড়িতে বসা সিনহার পরিচয় দেন। এতে আসামিরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাঁরা চালকের আসনে বসে থাকা সিনহাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন।
এ পর্যায়ে সিনহা গাড়ি থেকে নেমে দুই হাত ওপরে তুলে বারবার নিজের পরিচয় দিতে থাকেন। কিন্তু সিনহাকে উদ্দেশ্য করে আরও গালমন্দ শুরু করেন মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলী। তিনি বলতে থাকেন, ‘তোর মতো বহুত মেজরকে আমি দেখছি। এইবার খেলা দেখামু।’ এরপর লিয়াকত আলী টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন দিয়ে সলাপরামর্শ করতে থাকেন। একপর্যায়ে লিয়াকত আলী ফোনে ওসি প্রদীপকে বলতে থাকেন, ‘ঠিক আছে, শালারে শেষ কইরা দিতাছি।’ এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই লিয়াকত আলী সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে মেজর (অব.) সিনহার শরীরে কয়েকটি গুলি করেন। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান। নিজের জীবন রক্ষার্থে তিনি ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন অন্য আসামিরা তাঁকে চেপে ধরে পুনরায় মাটিতে ফেলে দেন। এ সময় সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরও একটি গুলি করেন লিয়াকত আলী। পরে ঘটনাস্থলে আসেন ওসি প্রদীপ। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকবার লাথি মেরে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এ ছাড়া নিজের বুট দিয়ে ঘষা মেরে সিনহার মুখমণ্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময় মামলার সাক্ষীদের ও ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনকে আসামিরা অস্ত্র উঁচিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাড়িয়ে দেন।
রাত ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশের বিরুদ্ধে এমন এক সময়ে মামলা দায়ের করা হলো যখন মেজর (অব.) রাশেদ নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশ এবং সেনাবাহিনী পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। মেজর (অব.) রাশেদ নিহতের ঘটনা সেনাবাহিনীর মধ্যে দৃশ্যত ক্ষোভের জন্ম দেয়।
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা বা ডিজিএফআই’র একটি গোপন তদন্ত রিপোর্ট এরই মধ্যে গণমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে।
সে রিপোর্টে বলা হয়, কর্তব্যরত পুলিশের এসআই যা করেছেন সেটি সামরিক বাহিনীর প্রতি ‘অশ্রদ্ধা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ’।
অন্যদিকে টেকনাফ থানায় পুলিশ যে মামলা দায়ের করেছে সেখানে বলা হয়েছে, মেজর (অব.) রাশেদ এবং তার সাথে গাড়িতে থাকা সিফাত পরস্পর যোগসাজশে সরকারি কর্তব্য কাজে বাধা প্রদান করেছে এবং হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করার জন্য তাক করেছে।