স্টাফ রিপোর্টার:
দেশে আবারও বন্যার আগমনী শঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। আগস্টের শেষে আসতে পারে সেই বন্যা। এমন আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এতে করে বন্যা কবলিত মানুষের কপালে নতুন করে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে। দেশের ৩৩ জেলার ওপর দিয়ে সম্প্রতি বয়ে যাওয়া বন্যার পানি নামতে না নামতেই আবারও বন্যার খবরে তারা চেখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। সরকারের পক্ষ থেকে যাবতীয় সহায়তার আশ্বাসেও ঘুচছে না সেই দুশ্চিন্তার ছাপ। বন্যার্তরা বলছেন, সরকারের দেওয়া ত্রাণ সহায়তায় জীবন চলে না। বন্যা কবলিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, দেশের ৫টি নদীর ৫ পয়েন্টে আবারও পানি বেড়েছে। এগুলো হচ্ছে—নাটোরে গুর, নওগাঁয় আত্রাই, টাঙ্গাইলে ধলেশ্বরী, রাজবাড়ীতে পদ্মা ও বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বাড়ছে। এই মুহূর্তে সেখানকার পানি বিপৎসীমার ওপরে অবস্থান করছে। গত কয়েকদিনে দেশের প্রায় সব নদীর পানিই বিপৎসীমার নিচে নেমে এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই গুর নদীর সিংড়া পয়েন্টের পানি এখন বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একইভাবে আত্রাই নদীর বাঘাবাড়ি পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার, ধলেশ্বরী নদীর এলাসিন পয়েন্টে ১২ এবং পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ১০ দিন ধরে এসব নদ-নদীর পানি বাড়বে, এমন পূর্বাভাস জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদ ও যমুনা নদীর পানি বেড়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সিরাজগঞ্জ জেলার সিরাজগঞ্জ সদর ও কাজীপুর, জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ, টাঙ্গাইলের এলাসিন এবং মানিকগঞ্জ জেলার আরিচা পয়েন্টে পানি আগামী তিন দিনের মধ্যে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এছাড়া, পদ্মা ও গঙ্গা নদীর পানিও বাড়তে পারে। ফলে এর ধারাবাহিকতায় রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ পয়েন্ট, মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকুল পয়েন্ট এবং শরীয়তপুর জেলার সুরেশ্বর পয়েন্টে পানি বাড়তে পারে। গোয়ালন্দ পয়েন্টের পানি আগে বাড়তে পারে। এরপর সুরেশ্বর ও ভাগ্যকুল পয়েন্টের পানি ১৮ আগস্টের মধ্যে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
এদিকে মঙ্গলবার (১৮ আগস্ট) আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারী (৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিপাতের এ ধারা আগামী আরও তিন দিন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
দেশে কয়েকদিনের ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বাড়ছে নদী-খাল-বিলের পানি। দেশের অধিকাংশ জায়গায় মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হলেও কিছু অঞ্চলে অতিভারী বৃষ্টি হয়েছে। এ সময় এমন বৃষ্টিপাত বন্যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার অতীতে যেভাবে বন্যা মোকাবিলা করেছে, ঠিক একইভাবে আসন্ন বন্যাও মোকাবিলা করার জন্য সব জেলা প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যা কবলিত মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে গুটিয়ে না ফেলে আবারও প্রস্তুত করার জন্য বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, যেসব বাঁধ ভেঙে গেছে, নতুন করে পানি বাড়ার আগেই যদি তা মেরামত করা সম্ভব হয়, জরুরি ভিত্তিতে সেসব বাঁধ নির্মাণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বন্যার্ত এলাকায় বসবাসরত মানুষের জানমাল রক্ষায় যেকোনও ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় পুনর্বাসনের কাজে নেমে পড়ার জন্যও বলা হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু আগে থেকে প্রস্তুত রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নতুন করে কিছু প্রয়োজন হলে আগেভাগেই তা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘বন্যার পানির চেয়ে এ জেলায় ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে নদী ভাঙন। নদী ভাঙনে শত শত পরিবার ঠিকানাহীন হয়ে পড়ছে। এসব মানুষকে নতুন জায়গায় নতুন বাড়ি বানিয়ে দিয়ে পুনর্বাসিত করার নির্দেশ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। আমরা সেই নির্দেশনা মেতাবেক কাজ করছি।’
গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন বলেন, ‘বন্যার পানির সঙ্গে নদী ভাঙন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, কৃষি অধিদফতর, মৎস্য অধিদফতরসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে কাজ করছি। কারণ, বন্যার পানি ২/৪ দিন পর নামবেই। কিন্তু পানি নেমে যাওয়ার পরের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা বড় কঠিন। তখন একদিকে বন্যার্ত মানুষদের পুনর্বাসন করার কাজটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পাশাপাশি অবকাঠামো মেরামত, বাঁধ মেরামত, আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত স্কুল-কলেজ মাদ্রাসাগুলোকে পাঠদানের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলার কাজটিও করতে হয়।’
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার স্কুল শিক্ষক শাহিনুর রহমান জানান, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হলে যেকোনও জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া যায়। কিন্তু বারবার কে এভাবে দিনের পরদিন আশ্রয় দেবে? সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে তো থাকার পরিবেশ নেই। একের পর এক বন্যায় আমরা তো শেষ হয়ে যাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে কোনও কিছুরই কমতি নেই। আমি এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব সার্বক্ষণিক জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। বন্যা পরিস্থিতির আপডেট জানছি। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি মনিটর করছেন। কোথাও কোনও ত্রুটি মনে হলে তা সংশোধনের নির্দেশ দিচ্ছেন। বন্যার্ত এলাকায় যখন যা প্রয়োজন, কাল বিলম্ব না করে তা অতি দ্রুততার সঙ্গে বরাদ্দ এবং সেখানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বলেছেন। ’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দু’দফা বন্যায় হুমকির মুখে পড়েছে দেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, অবকাঠামো ও বাড়িঘর। পানির নিচে ডুবে আছে কমপক্ষে দেড় লাখ হেক্টর ফসলি জমি। বীজতলা নষ্ট হওয়ায় শঙ্কা বেড়েছে আমনের উৎপাদন নিয়ে। নদী ভাঙনে চলে গেছে হাজার হাজার বাড়িঘর। কৃষকরা বলছেন, নতুন করে বীজ বা চারা কেনার সামর্থ্য তাদের অবশিষ্ট নেই। এমতাবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের বিনামূল্যে আমনের চারা এবং শাকসবজির বীজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যেই কৃষি মন্ত্রণালয় সেই উদ্যোগ নিয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেছেন, বন্যায় ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে বীজতলার ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। এর জন্য শুধুমাত্র ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় দেওয়ার জন্য ২৫০ মেট্রিক টন আমন বীজের চারা করেছি। অন্য এলাকায় বিতরণের জন্যও আমনের বীজ তৈরি করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপের বন্যার আর্থিক ক্ষতি নিরূপণে কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। ২৫ জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত প্রথম দফা বন্যায় কৃষকের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, দেশে দ্বিতীয় ধাপের বন্যায় ধান, সবজি, ভুট্টাসহ ১৪টি ফসলের প্রায় দেড় লাখ হেক্টর জমি প্লাবিত হয়েছে। এরমধ্যে আউশ ও আমন ধানের জমিই এক লাখ হেক্টর। এর বাইরেও প্রায় ৯ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমির আমন বীজতলা নষ্ট হয়েছে। তবে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বন্যায় এ পর্যন্ত ১২০ কোটি টাকার অবকাঠামো ও আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।