মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে স্থানীয় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আবারও ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরুর পরিকল্পনা করছেন বলে স্থানীয় এক কর্মকর্তা গ্রাম প্রধানদের সতর্ক করে দেয়ার পর হাজার হাজার মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন। স্থানীয় এক সংসদ সদস্য ও দাতব্য সংস্থার বরাত দিয়ে রোববার ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
তবে দেশটির সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, শনিবার রাতে সীমান্তবিষয়ক কর্মকর্তাদের জারিকৃত জনগণকে সরিয়ে নেয়ার এক আদেশ বাতিল করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারি নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল স্বীকার করে রাজ্যের সীমান্ত-বিষয়ক দফতর বলেছে, এতে অল্প কিছু গ্রাম প্রভাবিত হবে।
বুধবার স্থানীয় গ্রাম্য প্রধানদের সতর্ক করে একটি চিঠি দেয়া হয়; এই চিঠি দেখতে পেয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স। রাজ্য সরকারের মন্ত্রী কর্নেল মিন থান চিঠির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। রাখাইনের রাথেডং শহরের প্রশাসক অং মিন্ট থেইন স্বাক্ষরিত চিঠিতে গ্রাম প্রধানদের কিয়াওকটান শহর ও আশপাশের গ্রামে সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে অভিযান চালানোর পরিকল্পনার ব্যাপারে তিনি অবগত হয়েছেন বলে জানান।
তবে কোন জায়গা থেকে এই অভিযান পরিচালনার নির্দেশনা এসেছে সেব্যাপারে চিঠিতে কিছু উল্লেখ করেননি প্রশাসক অং মিন্ট। তবে রাখাইনের সীমান্ত কল্যাণ এবং নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী মিন থ্যান বলেছেন, এটি তার নেতৃত্বাধীন সীমান্ত কল্যাণবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা। দেশটির সেনাবাহিনী যে তিনটি মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে এটি তার একটি।
প্রশাসকের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব গ্রামে সামরিকবাহিনী ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ পরিচালনা করবে। রাখাইনের স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নাম উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, ‘অভিযান পরিচালনার সময় যদি আরাকান আর্মির বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়, তাহলে গ্রামে অবস্থান করবেন না। সাময়িকভাবে গ্রামের বাইরে চলে যাবেন।’ এই চিঠির ব্যাপারে প্রশাসকের মন্তব্য জানতে পারেনি বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
মিন থ্যান বলেন, চিঠিতে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ বলে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে সামরিক বাহিনীর অভিযানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রশাসক তার মন্ত্রণালয়ের এই আদেশকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই অভিযান শুধুমাত্র অল্প কয়েকটি গ্রামে শুরু হবে, কয়েক ডজন গ্রামে নয়। তবে চিঠির অন্যান্য বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন তিনি।
টেলিফোনে রয়টার্সকে মিন থ্যান বলেন, অভিযান এক সপ্তাহ সময় পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। যারা আরাকান আর্মির অনুগত রয়েছেন তারাও টার্গেট হবেন। শনিবার দেশটির সরকারের মুখপাত্র জ্য হতেই ফেসবুকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, সরকার সামরিক বাহিনীকে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শব্দটি ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছিল। জনগণকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ সংক্রান্ত সরকারি আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে আদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে জানতে রয়টার্স তাকে টেলিফোন করলেও তাতে সাড়া মেলেনি।
মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশ; যা আরাকান নামেও পরিচিত। এই প্রদেশ অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করে আসছে রাখাইন জাতিগত বৌদ্ধরা। চলতি বছরেও রাখাইনে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে হাজার হাজার মানুষ বাস্ত্যুচুত ও কয়েক ডজন মানুষ মারা গেছেন।
স্থানীয় মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর বরাত দিয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, গত জানুয়ারি এবং মার্চে রাখাইনে সংঘর্ষে অন্তত ১৮ শিশু নিহত ও আরও ৭১ জন আহত অথবা পঙ্গু হয়েছেন। তবে দেশটির সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের টার্গেট করেনি।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অভিযানে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ওই অভিযানকে জাতিসংঘ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূলের উদ্দেশে মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরিচালনা করেছিল বলে অভিযোগ করেছে। সেসময় লাখ লাখ মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, হত্যা, নারী ও শিশুদের ধর্ষণের অভিযোগও ওঠে। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।
শনিবার মিয়ানমারে নিযুক্ত ব্রিটিশ, অস্ট্রেলীয়, মার্কিন এবং কানাডার দূতাবাস রাখাইনে নতুন করে সামরিক অভিযানের খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নতুন অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর কিয়াওকতান ছেড়ে রাথেডং শহরে অন্তত ৮০ জন পালিয়েছে। সেনাবাহিনী পালিয়ে আসা এসব লোকজনের আশ্রয় এবং খাবারের ব্যবস্থা করছে বলে জানিয়েছেন মিন থ্যান।
স্থানীয় দাতব্য সংস্থা রাখাইন এথনিক কংগ্রেসের সেক্রেটারি জ্য জ্য তুন বলেন, প্রতিবেশি পন্যাগিয়ুন শহরে অন্তত এক হাজার ৭০০ মানুষ পালিয়েছেন। এছাড়া পাশের একটি গ্রামে আরও এক হাজার ৪০০ জন আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের খাদ্য এবং অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ জরুরি হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক বলেছে, কিয়াওকতান শহরে ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের আদেশ জারি হওয়ার পর অন্তত ৩৯টি গ্রামের মানুষ পালাতে শুরু করেছেন। রাখাইন এথনিক কংগ্রেস বলছে, কিয়াওকতান রোহিঙ্গা এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের লাখ লাখ মানুষের বসবাস।
রাখাইনের অধিকাংশ এলাকায় সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। যে কারণে সেখানকার প্রকৃত চিত্র জানাও কঠিন হয়ে পড়েছে।