গত ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে একদিনে ২ হাজার ১১৫ জন করোনা রোগী শনাক্তের কথা জানিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ওই দিনই প্রথমবারের মতো দ্য ইকোনমিস্টের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছিল করোনাভাইরাসের খবর। গত ২৮ জুন একদিনে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজারের বেশি। অর্থাৎ ওইদিন প্রতি ৯০ মিনিটে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ ফেব্রুয়ারি সারাদিন শনাক্তের সমান।
বিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ এখনও শুরু হয়নি, কারণ প্রথম ধাক্কাই এখনও কাটেনি! এ পর্যন্ত এক কোটির বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, ভাইরাসটি ছড়িয়েছে প্রায় বিশ্বের সবখানেই। চীন, তাইওয়ান, ভিয়েতনামের মতো কিছু দেশ মহামারি নিয়ন্ত্রণে এনেছে; লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও ভাইরাসের তাণ্ডব চলছে; যুক্তরাষ্ট্রের মতো আরও কিছু দেশ নিয়ন্ত্রণ হারানোর পথে রয়েছে; আফ্রিকার দেশগুলো রয়েছে মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে; ইউরোপ আছে এগুলোর মাঝামাঝি কোনও অবস্থানে।
আরও ভয়াবহ দিন সামনে। ৮৪টি দেশের ওপর গবেষণা চালিয়ে সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি জানিয়েছে, প্রতিটি নতুন রোগী শনাক্তের বিপরীতে আক্রান্ত ১২ জন অশনাক্তই থেকে যাচ্ছে, করোনায় প্রতি দুই মৃত্যুর বিপরীতে তৃতীয়টিকে অন্য রোগের ফলাফল বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি না আসলে ২০২১ সালের মাঝামাঝি করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ২০-৬০ কোটিতে। এসময়ের মধ্যে মারা যেতে পারে ১৪-৩৭ লাখ মানুষ। ওই সময়ও বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।
করোনাভাইরাস কতটা ছড়াবে তা নির্ভর করে মূলত সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ওপর। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা যায় তিনটি ধাপে- টেস্টিং, ট্রেসিং (শনাক্ত) ও আইসোলেশন। এগুলো যদি ব্যর্থ হয় তবে লকডাউন। এছাড়া জনস্বাস্থ্য সেবার খরচও থাকতে হবে সীমার মধ্যে।
ব্যাপক হারে করোনা ভ্যাকসিন ব্যবহার এখনও অনেক দূরে, তবে ইতোমধ্যে প্রাথমিক থেরাপিগুলো পাওয়া যাচ্ছে। সুচিকিৎসার কারণেই ব্রিটেনে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি রোগীর সংখ্যা মার্চের ১২ শতাংশ থেকে নেমে মে মাসে ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
মহামারি পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে অর্থনীতিও। যদিও এখনও বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা বেশ নাজুক। জে পি মর্গান ব্যাংকের মতে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৩৯টি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১০ শতাংশ হ্রাস পাবে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বিকল্প উপায়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে নিয়েছে। চীনে স্টারবাকস ‘সংস্পর্শহীন’ বিক্রয় পদ্ধতি চালু করেছে, ফলে কফিশপে ভোক্তাদের অবস্থানের সময় অনেকটাই কমে গেছে। বিভিন্ন কলকারখানা কর্মীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এবং কর্মঘণ্টা পুনর্বণ্টন করে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
দেশব্যাপী লকডাউন এখন আর নেই বললেই চলে। বিভিন্ন দেশ বাইরে বড়ধরনের জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করে স্কুল-কলেজ ও দোকানপাট চালুর অনুমতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্য কড়াকড়ি একটু দ্রুত তুলে নেয়ায় সংক্রমণ ফের বেড়েছে। ফলে আবারও বিধিনিষেধ ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে তারা। মার্কিন রাজ্যগুলোর এই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে বাকি বিশ্ব।
মূল সমস্যাটা হচ্ছে, উপযুক্ত ওষুধ বা প্রতিষেধক ছাড়া ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে মানুষের সামাজিক আচরণের ওপর। মাস্ক সংক্রমণ রোধে সাহায্য করলেও ইউরোপ-আমেরিকার অনেকেই সেটি পরতে রাজি নয়। হাতধোয়া ভাইরাস নিধন করে, কিন্তু অনেকেই পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারছে না। মহামারির মধ্যে পার্টি করা বিপজ্জনক, কিন্তু তরুণদের তাতে থোড়াই কেয়ার। তার ওপর, সময় যত যাচ্ছে মানুষের অর্থের সংকটও তত বাড়ছে। ফলে কাজের প্রয়োজনেই বাইরে বের হচ্ছেন অনেকে।
সামাজিক রীতিনীতি বদলে দেয়া সহজ নয়। এজন্য দরকার জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ এবং বিশ্বাস স্থাপন। যদিও অনেকেই নিজ দেশের নেতাদের বিশ্বাস করেন না। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রাজিল, ইরানের মতো দেশগুলোর প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীরা করোনাভাইরাসের ঝুঁকিকে হেলাফেলা করেছেন, ভুলভাল পরামর্শ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন তারা। অনেকের কাছেই দেশের চেয়ে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষাই বড় বলে মনে হয়েছে।
সব কথার শেষ কথা, করোনাভাইরাস এত শিগগিরই যাচ্ছে না। আরও বহু মানুষ এতে আক্রান্ত হবেন, মারাও যাবেন অনেকে। মনে রাখতে হবে, আপনার হয়তো করোনাভাইরাস মহামারির ওপর আগ্রহ কমে গেছে, কিন্তু আপনার ওপর করোনার আগ্রহ মোটেও কমেনি।
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনূদিত