স্টাফ রিপোর্টার:
কনসালটেন্ট ও ক্লিনিক্যাল সাইক্রিয়াটিস্ট ছাড়াই চলছে মানসিক হাসপাতাল। পাবনার হেমায়েতপুরে অবস্থিত ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট দেশের একমাত্র বিশেষায়িত পাবনা মানসিক হাসপাতালে ৩০ জন চিকিৎসক পদের মধ্যে ১৭ জনের পদই শূন্য রয়েছে। আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও), অ্যানেসথেটিস্ট, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট, ডেন্টাল সার্জনের মত গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক ছাড়াই চলছে এই মানসিক হাসপাতাল। তবে সীমিত চিকিৎসক ও জনবল দিয়েই যথাসম্ভব সেবা দেয়া হচ্ছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালটির জন্য ৩০ চিকিৎসকসহ মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ৬৪৩। ১৩ চিকিৎসকসহ কর্মরত রয়েছেন ৪৫৩ জন এবং শূন্য রয়েছে ১৯০টি পদ। জনবলের অভাবে এখন নিজেই ধুকছে হাসপাতালটি। শুধু তাই নয়, ৫০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য অনুমোদন রয়েছে মাত্র ২০০ শয্যার হাসপাতালের জনবল। এই ২০০ শয্যার জনবলের জন্য প্রথম শ্রেণির চিকিৎসকের যে ৩০টি পদ মঞ্জুর আছে তার মধ্যে আবার ১৭টি পদই রয়েছে শূন্য। অন্যান্য কর্মকর্তা এবং কর্মচারী পদেও একই অবস্থা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, জরুরি ভিত্তিতে সিনিয়র কনসালটেন্ট, ক্লিনিক্যাল সাইক্রিয়াটিস্ট, মেডিকেল অফিসার দ্রুত নিয়োগ করা না হলে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
জানা গেছে, দেশের একমাত্র মানসিক হাসপাতালটি পাবনা জেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে হেমায়েতপুরে অবস্থিত। ১৯৫৭ সালে পাবনা জেলার সাবেক এক সিভিল সার্জন ‘শীতলাই হাউজ’ নামক জমিদার বাড়িতে এটি অস্থায়ীভাবে স্থাপন করেন। ১৯৫৯ সালে হেমায়েতপুরে ১১২.২৫ একরের একটি চত্বরে হাসপাতালটি স্থানান্তরিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শয্যা সংখ্যা ছিল ৬০। ১৯৫৯ সালে দুইশ এবং ১৯৬৬ সালে চারশ এবং ২০০০ সালে হাসপাতালটিকে পাঁচশ শয্যায় উন্নীত করা হয়।
মোট শয্যার ২৮০টি নন-পেয়িং এবং ১২০টি পেয়িং আর প্রকল্পর অধীনে ১০০ শয্যা রয়েছে। হাসপাতালটির মোট ১৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে পুরুষ রোগীর জন্য ১৩টি (১১টি নন-পেয়িং, দুটি পেয়িং) এবং নারী রোগীদের জন্য পাঁচটি (৪টি নন-পেয়িং, ১টি পেয়িং) নির্দিষ্ট। প্রতিষ্ঠার অর্ধ শতাব্দী পর জনসংখ্যা ও মানসিক রোগীর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেলেও সে অনুপাতে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বা চিকিৎসকের পদ সংখ্যা বাড়েনি।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. এটিএম মোর্শেদ জানান, এখানে কোনো চিকিৎসকের পোস্টিং দেয়া হলেই তিনি বা তারা মনে করেন তাকে ‘শাস্তি’ দেয়া হলো। ফলে এখানে দীর্ঘদিন ধরেই চিকিৎসক সঙ্কট রয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ১০০০ শয্যার নতুন হাসপাতাল ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া রয়েছে। কিন্তু এসব ফাইল বন্দি অবস্থায় রয়েছে।
চিকিৎসকের সংখ্যা যেখানে বাড়ানো দরকার সেখানে অনুমোদিত ৩০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ১৭ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ককে প্রশাসনিক কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। সেদিক হিসেবে করলে চিকিৎসক আরও কম।
ডা. এটিএম মোর্শেদ জানান, নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও আউটডোরে (বহির্বিভাগে) প্রতিদিন গড়ে চারশ থেকে সাড়ে চারশ রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়। গত ৪ অক্টোবর আউটডোরে ৩০২ জন পুরুষ আর ১১২ জন নারী রোগী মিলে মোট ৪২৪ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। আর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ২৯ জন রোগীকে। প্রতি বছর আউটডোরে ২৫-৩০ হাজার রোগী এবং আন্তঃবিভাগে এক হাজার-১২শ রোগীর চিকিৎসা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক জানান, চিকিৎসকের পদ ছাড়াও প্রথম শ্রেণির আটজন কর্মকর্তা পদের মধ্যে চারজনের পদ শূন্য। অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির ৩১৬টি পদের মধ্যে ২৭৫টি পদ শূন্য, তৃতীয় শ্রেণির ১১৯টি পদের মধ্যে ৮৮টি পদ ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ১৭০টি পদের মধ্যে ৯৭টি পদ শূন্য। এতে রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
২৬৪ জন সিনিয়র নার্সের পদ থাকলেও বর্তমানে শূন্য রয়েছে ১৬টি পদ। আর স্টাফ নার্সের ৪৫ জনের মধ্যে ২২টি পদ শূন্য রয়েছে। কর্মরত এ নার্সদের আবাসিক কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালটি শহর থেকে দূরে হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহনের জন্য নেই কোনো যানবাহন। পরিচ্ছন্ন কর্মীদের (সুইপার) সংখ্যা অপ্রতুল। সুইপারের ৩০টি পদের মধ্যে ১৭টি পদ শূন্য। দেশের একমাত্র বিশেষায়িত এ হাসপাতালের এমন অবিশ্বাস্য করুণ অবস্থা চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
তিনি আরও জানান, চিকিৎসক ছাড়াও হাসপাতালে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদেরও বিরাট প্রয়োজন। রোগীদের গোসল, খাওয়া দাওয়া, পায়খানা-প্রসাব করানো ও পরিষ্কার করার কাজে পর্যাপ্ত কর্মচারী ও সুইপার প্রয়োজন।
এদিকে পাবনা মানসিক হাসপাতালের প্রতিজন রোগীর খাদ্য বাবদ দৈনিক বরাদ্দ ১২৫ টাকা। এই টাকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাদ কাটা গিয়ে দাঁড়ায় ১০৬ টাকা ২৫ পয়সা। তার মধ্যে রয়েছে ঠিকাদারের লাভ, অফিস খরচ ইত্যাদি। এসব ব্যয় বাদে যে টাকা থাকে তা দিয়ে রোগীদের তিন বেলা খাবার এবং বিকেলে নাস্তা দেয়া হয়।
কিচেন অফিসার মকবুল হোসেন জানান, স্বল্প বাজেটের মধ্যেও রোগীদের যতদূর সম্ভব ভালো খাবার দেয়া হয়।
গত ৪ অক্টোবর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরের জন্য ডিম আর রাতের জন্য মাংস রান্না হচ্ছে। কিচেন অফিসার মকবুল হোসেন জানান, রান্নাঘর থেকে শুরু করে পরিবেশন সবই স্বাস্থ্যসম্মতভাবে করা হচ্ছে। তবে বাজার দর অনুযায়ী এ অল্প টাকায় মানসিক রোগীদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দেয়া অনেক কঠিন।
সুস্থ রোগীদের বাড়ি ফেরার আকুতি
‘ভাই আমি ভালো হয়ে গেছি, আমার বাড়িতে একটু খবর দেবেন’…! পাবনা মানসিক হাসপাতালে গেলে এ রকম কথা হাসপাতালের প্রায় ওয়ার্ড থেকেই শোনা যায়। অনেকের ধারণা মানসিক রোগীরা এমন বলেই থাকেন। কিন্তু চিকিৎসকরা জানালেন ভিন্ন কথা।
তারা বলেন, মানসিক রোগীদের আত্মীয়-স্বজন এমনকি তাদের ভাই- বোনরাও পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন। এর কিছু সামাজিক কারণ ও কুসংস্কার রয়েছে। অনেকে পারিবারিক সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার জন্যও মানসিক রোগীদের দূরে সরিয়ে রাখেন।
এক্ষেত্রে অধিকাংশ পরিবার একবার রোগী এখানে রেখে যেতে পারলে আর তার খোঁজ নিতে চান না। অনেকে ভুল ঠিকানায় রোগী ভর্তি করিয়ে দিয়ে যান। ফলে রোগী সুস্থ হওয়ার পর কিংবা যাদের আর কখনও সুস্থ হওয়ার আশা নেই তাদের অভিভাবকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে গেলে ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না।
বছরের পর বছর যুগের পর যুগ মানসিক হাসপাতালেই কেটে যাচ্ছে এ রকম রোগী রয়েছেন ২১ জন। তারা শুধু প্রতীক্ষা করেন কেউ তাদের ঠিকই একদিন নিতে আসবে। কিন্তু তাদের কেউ আর নিতে আসে না। অনেকেই প্রতীক্ষা করতে করতে এখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ২০১৫ সালে এরকমভাবে মারা গেছেন দুজন।
মানসিক হাসপাতালের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগী সাইদ হোসেন। ভর্তি রেজিস্ট্রার অনুযায়ী তাকে ১৯৯৬ সালে ভর্তি করে যান তার স্বজনরা। তিনি অনেক আগে সুস্থ হলেও কেউ তাকে নিতে আসেননি। তাই তিনি বছরের পর বছর হাসপতালে বন্দী থাকার মত থেকে অনেকটা অথর্ব হয়ে গেছেন।
তিনি বলেন, খুব ইচ্ছে করে বাসায় যেতে। কিন্তু কেউ নিতে আসে না।
সুস্থ হয়েও বাড়ি যেতে না পারার বেদনা এভাবেই ব্যক্ত করেন সাইদের মতো আরও অনেক রোগী। তারাও এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েও বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন না। এদের কারও ঠিকানা ভুল, আবার কোনো অভিভাবক বা পরিবারের সদস্য তাদের নিতেও রাজি নয় বলে ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন।
এদিকে মানসিক হাসপাতালে দালাল চক্রের কাছে হাসপাতালের কর্মকর্তা- কর্মচারীরা জিম্মি। হাসপাতালে রোগী ভর্তিতে দালাল চক্র মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা করে আদায় করে। তারা আউটডোরে ডাক্তার দেখানোর কথা বলেই একজন রোগীর অভিভাবকের কাছ থেকে ২-৩ হাজার টাকা আদায় করে। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বেশ কিছু রোগীর অভিভাবক জানালেন দালালদের টাকা আদয়ের কথা।
গত ৪ অক্টোবর ফরিদপুর উপজেলার ভাঙ্গা উপজেলা থেকে আসা আলেপ হোসেন জানান, তিনি তার রোগীকে নিয়ে রাতে রওয়ানা দিয়ে ভোরে এখানে পৌঁছান। এসে সিরিয়াল পাওয়ার জন্য দুই হাজার টাকা দেন দালালকে। তারপরও দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সিরিয়াল পাননি।
রাজশাহী থেকে আসা শাহনাজ খাতুন জানান, তিনি পায়েল (৩৫) নামে এক গরিব নারীকে নিয়ে এসছেন। সাত বছর ধরে এখানে আউটডোরে তাকে দেখাতে পারলেও টাকার অভাবে ভর্তি করাতে পারেননি।
মানসিক হাসপাতালে ভর্তি না হতে পেরে সাধারণ রোগীরা দালালদের খপ্পরে পরে প্রতারিত হচ্ছেন। দালালরা রোগী ভাগিয়ে তাদের ক্লিনিকে ভর্তি করছে। এতে বেসরকারি মানসিক ক্লিনিকে ভর্তি হওয়া রোগীদের মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রে আরও সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
রোগী ভর্তির ব্যাপারে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. এটিএম মোর্শেদ জানান, কেউ ইচ্ছে করলেই কোনো রোগীকে ভর্তি করাতে পারেন না। রোগীকে অবশ্যই আউটডোরে ১০ টাকার টিকিট কেটে দেখাতে হয়। তারপর তিন সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিম ভর্তিযোগ্য হলে সিট খালি থাকা শর্তে ভর্তির সুপারিশ করেন।
রোগীর বয়স ১৮ হতে হয়। মানসিক রোগসহ অন্য রোগ থাকলে ভর্তি করা হয় না। ভর্তি হতে ১৫ টাকা লাগে। আর রোগী ভালো হওয়ার পর তাকে বাড়িতে পৌঁছানোর যাতায়াত বাবদ পাঁচজনের ভাড়া জামানত রাখা হয়। ভর্তি হওয়ার সময় লিগ্যাল অভিভাবকের জাতীয় পরিচয়পত্র, নিজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের নাগরিকত্ব সনদ ও ছবি লাগে।
ডা. এটিএম মোর্শেদ বলেন, এই হাসপাতালকে আধুনিক ও যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অনেক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। হাসপাতালাটির সেবার মান আরও উন্নত করতে হলে এখানে চিকিৎসক এবং কর্মচারীদের শূন্য পদ পূরণ জরুরি।